শ্রী শ্রী সরস্বতী ।
দেবী সরস্বতী: জ্ঞান, নির্মলতা ও সত্ত্বগুণের অধিষ্ঠাত্রী
দেবী সরস্বতী হিন্দু ধর্মের এক মহান দেবী, যিনি বুদ্ধি, বিদ্যা, জ্ঞান, সংগীত ও শিল্পকলার অধিষ্ঠাত্রী। তাঁর নামেই জ্ঞানের উৎস, কণ্ঠের বাণী এবং শিল্পের শুদ্ধতা একাকার হয়ে যায়। ‘সরস্বতী’ শব্দের অর্থ—জ্যোতির্ময়ী, অর্থাৎ আলোর উৎস, জ্ঞানপ্রদীপ।
উত্পত্তি ও রূপ
দেবীভাগবত পুরাণ অনুসারে, দেবী সরস্বতী ভগবান বিষ্ণুর জিহ্বাগ্র থেকে উৎপন্ন হন। সৃষ্টির সূচনাকালে, যখন ব্রহ্মা জগৎ রচনার পরিকল্পনা করেন, তখন তাঁর চিন্তা ও সৃজনের সহায় রূপে আবির্ভূত হন দেবী সরস্বতী। সরস্বতী লক্ষ্মী ও পার্বতীর সঙ্গে ত্রিদেবীর অন্যতমা।
তিনি শুক্লবর্ণা, পীতবস্ত্রধারিণী, তাঁর চার হাতে বীণা, পুস্তক, অক্ষমালা ও অঞ্জলি ধারণ করেন। তাঁর বাহন শ্বেতহংস, যা বিচক্ষণতা ও বোধের প্রতীক।
বাগ্দেবী ও ধ্বনিরূপা
কখনো তিনি বাগ্দেবী—ত্রয়ী লোক (ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ)-এ জ্ঞানরূপে পরিব্যাপ্ত। তন্ত্রশাস্ত্র অনুসারে, তিনি বাগীশ্বরী—অ থেকে ক্ষ পর্যন্ত পঞ্চাশটি বর্ণেই তাঁর দেহ গঠিত। অর্থাৎ, দেবী সরস্বতী স্বয়ং ধ্বনিরূপিণী, সমস্ত ভাষা ও জ্ঞানের আধার।
গরুড় পুরাণ-এ তাঁকে শ্রদ্ধা, ঋদ্ধি, কলা, মেধা, তুষ্টি, পুষ্টি, প্রভা ও স্মৃতি—এই আটটি গুণে গুণান্বিতা বলা হয়েছে।
পদ্মপুরাণ-এ উল্লিখিত সরস্বতীস্তোত্রম্-এ দেবী সরস্বতীকে শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা, শ্বেতবস্ত্রপরিহিতা, শ্বেতগন্ধ ও শ্বেতচন্দনে চর্চিতা, শ্বেত অলঙ্কারে ভূষিতা ও শ্বেতবীণাধারিণী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই সমগ্র শ্বেততত্ত্ব প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় নির্মলতা, পবিত্রতা ও সত্ত্বগুণের।
বসন্ত পঞ্চমী ও সরস্বতী পূজা
বসন্ত পঞ্চমী, মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয়। এই দিন ব্রহ্মা পরম জ্ঞান আহ্বান করলে দেবী সরস্বতী সাকার রূপে আবির্ভূত হন এবং ব্রহ্মার সহধর্মিণী হন। এই তিথিতে শিশুরা শিক্ষার সূচনায় ‘হাতেখড়ি’ নিয়ে সরস্বতী আরাধনা করে। শুধু ভারতেই নয়, জাপান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও মায়ানমারেও দেবী সরস্বতী পূজিত হন জ্ঞান ও শিল্পের দেবী রূপে।
গীতার দৃষ্টিতে সরস্বতী ও সত্ত্বগুণ
শ্রীমদ্ভগবদগীতার চতুর্দশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে—
"তত্র সত্ত্বং নির্মলত্বাত্", অর্থাৎ সত্ত্বগুণ, রজঃ ও তমঃ গুণের মধ্যে সর্বাধিক নির্মল ও পবিত্র। এই গুণ স্বচ্ছতা, বিশুদ্ধতা ও আলোকের প্রতীক।
একই অধ্যায়ের ১৭ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে—
"সত্ত্বাৎ সঞ্জায়তে জ্ঞানং", অর্থাৎ সত্ত্বগুণ থেকেই জ্ঞানের উৎপত্তি হয়।
এই সূত্র ধরেই দেবী সরস্বতীর পরিচয় হয় জ্ঞানপ্রদায়িনী রূপে—যিনি নির্মলতা ও আলোকের মাধ্যমে অন্তরের অন্ধকার দূর করেন।
উপসংহার
দেবী সরস্বতী কেবল বিদ্যার দেবী নন, তিনি চিত্তের নির্মলতা, বাকশক্তির শুদ্ধতা, মননের স্বচ্ছতা ও কর্মের শৃঙ্খলার প্রতীক। তাঁর আরাধনার মধ্য দিয়ে মানুষ আত্মজ্ঞান ও সত্ত্বগুণের পথে অগ্রসর হয়। তিনি সেই আলোক-প্রতিচ্ছবি, যিনি অজ্ঞানতা ও মোহের ঘোর কাটিয়ে জ্ঞানের পথে মানুষকে পরিচালিত করেন।
"या देवी सर्वभूतेषु बुद्धिरूपेण संस्थिता।
नमस्तस्यै नमस्तस्यै नमस्तस्यै नमो नमः॥"
Saraswati Stotra | Pt. Ravindra Sharma
লেখক পরিচিতি:- প্রবীর মহান্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উৎকল ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রবীরের বইগুলি Amazon.com. flipkart.com, abebooks.com এর মাধ্যমে বিক্রি হয়। গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিন থেকে সার্চ করে এখনো পর্যন্ত ১২ লাখের বেশি লোক প্রবীরের লেখা আর্টিকেল গুলি পড়েছেন।
Comment of Author:-
If anybody or any organization doesn't agree with any content of this article, he or they may mention it in the comments with documentary evidence and it will be corrected. Any comments in this regard without documentary evidence and source of Information will be treated as mala fide and will be deleted.