মুক্তি ,ভক্তি ও ষড়রিপু এবং মানব জীবনে ষড়রিপুর প্রভাব:ষড়রিপু কে নিয়ন্ত্রণ বা দমন করার উপায়।
পৃথিবীতে সৃষ্ট প্রাণীর মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ । এই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পেছনে মানুষের মধ্যে যে বিষয়গুলো সদা-সর্বদা ক্রিয়াশীল তা হলো তার বিবেক, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা।
1.বিবেক- হলো মানুষের অন্তর্নিহীত শক্তি যার দ্বারা ন্যায়, অন্যায়, ভালোমন্দ, ধর্ম,অধর্ম বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা অর্জিত হয়।
2.বুদ্ধি -হলো মানুষের বিচার শক্তি বা বোধশক্তি যার দ্বারা আমরা পেয়ে থাকি জীবন ও জগতে সংগঠিত যাবতীয় ক্রিয়াকলাপে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার বিজ্ঞানসম্মত ক্ষমতা ও দক্ষতা ।
3.বিচক্ষণতা হলো মানুষের দূরদর্শীতা যার মাধ্যমে মানুষ জীবনে আগত ও অনাগত বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে নিজেকে সর্বত্র সাবলীল ও সফল করে তুলতে সক্ষম হয়।
4.আত্মনিয়ন্ত্রণ- হলো মানুষের সংযমন যার দ্বারা মানুষ তার জীবনের সর্বত্র সংযত,সুসংবদ্ধ ও শৃঙ্খলিত জীবন অনুধাবনে সক্ষম হয়।
সুন্দর ও আদর্শ জীবন গঠনের উল্লেখিত সূচকগুলো যার কারণে প্রায়ই বাধাপ্রাপ্ত ও শ্বাসরুদ্ধ হয় তার নাম হলো ষড়রিপু । এই ষড়রিপু আমাদের মন অনিয়ন্ত্রত করে এবং অনিয়ন্ত্রত মন আমাদের কুপথে চালনা করে। মন কে নিয়ন্ত্রণ করতে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ ও অহংকার তত্ত্বের উপাস্য দেবতা প্রভু বল ভদ্র/সঙ্কর্ষণের ধ্যান করুন।
শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণে ষড়রিপুকে এই সংসার সাগরের জল জন্তু হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
এই সংসার সাগরে ভক্তি একটি নৌকা আর শ্রী হরি হলেন পারাপারের কান্ডারী কিন্তু এই ষড়রিপু না আমাদের নৌকার কাছে আস্তে দেয়, না মিলতে দেয় সংসার সাগর পারাপারের কান্ডারীর সাথে তাই মানুষ কে এই ষড়রিপু কে জানা ,চেনা ও এর থেকে মুক্তির উপায় জানা একান্ত প্রয়োজন।
এই সংসার সাগরে ভক্তি একটি নৌকা আর শ্রী হরি হলেন পারাপারের কান্ডারী কিন্তু এই ষড়রিপু না আমাদের নৌকার কাছে আস্তে দেয়, না মিলতে দেয় সংসার সাগর পারাপারের কান্ডারীর সাথে তাই মানুষ কে এই ষড়রিপু কে জানা ,চেনা ও এর থেকে মুক্তির উপায় জানা একান্ত প্রয়োজন।
ষড়রিপু কি ?:-
ষড়র অর্থ ছয় ও রিপুর অর্থ কণ্টক অথবা শত্রু ,অর্থাৎ ষড়রিপুর অর্থ হলো ছয়টি শত্রু। মানব জীবনে কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ(অহংকার) ও মাৎসর্য্য (হিংসা ) কে ষড়রিপু বলা হয় ।
ষড় রিপুর প্রথম রিপু হলো কাম।
কাম রিপু(lust)- কাম শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো কামনা,বাসনা,আসঙ্গ লিপ্সা ইত্যাদি । কাম শব্দের অর্থ যেমন কামনা, আবার মনে যে ভাবের উদয় হলে নারী পুরুষের প্রতি ও পুরুষ নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয় তাকেও বলে কাম ।কাম শব্দ যার আভিধানিক অর্থ যৌন সম্ভোগের ইচ্ছা ,জীবের বংশ বিস্তারের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তাই এই কামশক্তি মানুষের জন্য অপরিহার্য। কামশক্তি নেই সম্ভবত এমন কোন প্রাণীই পৃথিবীতে নেই। এই শক্তি ব্যতিরেকে একজন মানুষ গতানুগতিক রীতিতে অপূর্ণ মানুষ বলে বিবেচিত হয়। সুতরাং,প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই থাকা দরকার নিয়ন্ত্রিত কামশক্তি। এই নিয়ন্ত্রিত কামশক্তি যখন অনিয়ন্ত্রিত,বেপরোয়া ও বেসামাল হয়ে যায় তখনই তা হয়ে যায় শত্রু। অনিয়ন্ত্রিত কামশক্তি জন্ম দেয় পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে অবিশ্বাস,কলংক,শোক,সন্তাপ,অপমান,নিন্দা,লাঞ্ছনা এবং ভৎসনা।
মানুষ যদি কাম রিপুর (যৌন সম্ভোগের ইচ্ছার) বশীভূত হয়ে কাম রিপুর দাসত্ব করে তাহলে সে চরিত্রহীন হয় এবং জ্ঞান শুন্য হয়ে অমানুষে পরিণত হয় ও পরে ধর্মহীন হয়ে সে পাষণ্ড হয় এবং সে সমাজে- অসামাজিক এবং অপ্রাকৃতিক কাজ করে এবং সমাজ কে কলুষিত বা দূষিত করে । ষড়রিপুর মধ্যে কাম রিপু-ই সর্বাপেক্ষা দুর্জয় রিপু। কাম রিপু পঠন - পাঠন,কাজকর্ম , ঈশ্বরের পূজা ,উপাসনা, ইত্যাদি কাজে বাধা প্রদান করে ।
অন্যদিকে কাম শব্দের অর্থ কামনাঃ- মনে কামনার উদয় হলে ইন্দ্রিয় ,মন ,প্রাণ ,দেহ ,ধর্ম ,ধৈর্য্য,বুদ্ধি ,লজ্জা,শ্রী ,তেজঃ ,স্মৃতি ও সত্যের বিনাশ ঘটে। ভাগবত পুরাণ ,সপ্তম স্কন্ধ ,দশম অধ্যায়।
কামনার দ্বারা মানুষ জীবনে বেঁচে থাকার শক্তি পায়, কামনা আছে বলেই মানুষ মানুষকে ভালবাসে, ঘর বাঁধে, সংসারধর্ম পালন করে, কামনা আছে বলেই মানুষের মনে আকাঙ্ক্ষা, আবেগ,স্বপ্ন ও সঙ্গীতের সৃষ্টি হয়,মানুষ ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত ভাবে বড় বড় মহৎ উদ্দেশ্য গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের আপ্রাণ চেষ্টা করে। কামনাকে নির্মূল করা জটিল তবে নিয়ন্ত্রণ সহজ এবং সংসারী লোকেদের পক্ষে কামনা কে নিয়ন্ত্রণ করাই শ্রেয়।
কাম রিপু থেকে মুক্তির উপায় ।
কাম (যৌন সম্ভোগের ইচ্ছা) সর্বপ্রথম ইন্দ্রিয়ে প্রবিষ্ট হয়ে মন ও বুদ্ধিকে মোহিত করে এবং এর দ্বারা মানুষকে মোহিত করে। মন,বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়গুলো হচ্ছে এর আবাসস্থল বা অবলম্বন। তাই প্রথমে ইন্দ্রিয়গুলোকে নিজের বশে এনে এই কাম রুপী শত্রুকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আত্মজ্ঞান অর্জন কাম রিপুকে বশীভূত করতে পারে। কাম রিপু থেকে মুক্তির অন্য একটি উপায় হল সৎ ,বুদ্ধিমান,উত্তম চরিত্রসম্পন্ন ,ধার্মিক ও নির্ভীক এর সাথে বিবাহঃ। জীবনে যারা এই কামশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তারাই জীবনে সুখ,সমৃদ্ধি,মান,সম্মান লাভ করে,তারাই পৌছাতে পারে সফলতার শীর্ষে।
ষড় রিপুর দ্বিতীয় রিপু হলো ক্রোধ।
ক্রোধ রিপুঃ(anger)-
ক্রোধ রিপুঃ(anger)-
ক্রোধ শব্দের অর্থ হলো রোষ,দ্বেষ,চোট,ক্ষিপ্ততা,প্রকোপ,উষ্মা,গর্জন করা,উন্মাদনা,কোপ,প্রতিশোধ নেবার আবেগ প্রভৃতি । ক্রোধের অপর নাম রাগ। ক্রোধ দুই প্রকারঃ- রাগ এবং অনুরাগ।
রাগ:-মানুষ রাগের বশীভূত হয়ে অতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে, যার ফলশ্রুতিতে সে তার নিজের জীবনে, সংসারে, সমাজে অশান্তি বয়ে আনে। তাই রাগ কে সম্বরণ করে ধৈর্য্য ধারণ করাই জ্ঞানীর পরিচয়। রাগ হচ্ছে ধ্বংসাত্মক বা ক্ষতিকারক আর অনুরাগ হচ্ছে সৃজনশীল ও কোন মহৎ উদ্দেশ্য বা সাধনা বাস্তবায়নের সোপান স্বরূপ।
ক্রোধ রিপু থেকে মুক্তির উপায় ।
ক্রোধ খুবই দুর্জয় রিপু, ক্রোধ রিপুকে বশীভূত করতে না পারলে জীবনের কোন কাজেই সফলতা আসে না । ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তার মধ্যে শিষ্টাচার,ভদ্রতা,আত্মপ্রতিষ্ঠা বাড়ে এবং সে সহজে বিদ্যা অর্জন করতে পারে। ক্রোধ রিপুকে বশীভূত করতে হলে ধৈর্য্য, সহনশীলতা ও ক্ষমা গুণের অধিকারী হতে হয়। আত্মজ্ঞান অর্জন ক্রোধ রিপুকে বশীভূত করতে পারে।
ষড় রিপুর তৃতীয় রিপু হলো লোভ।
লোভ রিপু থেকে মুক্তির উপায় ।
লোভ খুবই দুর্দমনীয় রিপু, অতিরিক্ত লোভের কারণে মানুষ বিবেকহীন হয়ে মনুষ্যত্ব, ধর্ম-কর্ম হারিয়ে ফেলে। লোভ রিপুকে বশীভূত করতে হলে একান্তভাবে আত্মসংযমী হতে হবে, সংযম অভ্যাস দ্বারা ও হিতাহিত বোধকে জাগ্রত করে লোভ রিপুকে বশীভূত করা যায়।
ষড় রিপুর চতুর্থ রিপু হলো মোহ ।
মোহ রিপুঃ(attachment)- স্বপ্ন কে সত্যি ,অবাস্তবকে বাস্তব মনে করে এবং ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য ক্ষণস্থায়ী কিছু কিছু বিষয়ের উপর ভ্রান্তধারণা পোষন করে তাতে মোহিত হয়ে থাকার নামই মোহ। যেমন অর্থ-সম্পদের মোহ, রূপের মোহ, পূরুষের পরস্ত্রীতে মোহ, নারীর পূরুষের উপর মোহ,সংসারের মোহ, নেশার মোহ ইত্যাদি।
মোহ শব্দটি অজ্ঞানতা, অবিদ্যা, মুর্খতা, মূঢ়তা, নির্বুদ্ধিতা, ভ্রান্তি, মুগ্ধতা, মায়া, ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মোহ ষড় রিপুর মধ্যে এটি অন্যতম একটি রিপু। কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ ও মাৎসর্য এ সবকটির উপর মোহ প্রভাব খাঁটিয়ে থাকে। অর্থাৎ মোহ দোষে দূষিত ব্যক্তি বাকি পাঁচটি রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাকে যে কোন রিপু অতি সহজেই গ্রাস করতে পারে।
মায়া হলো মোহ রিপুর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অতিমায়া বা দয়া ক্ষেত্র বিশেষে এতই ক্ষতিকর যে তা আর পুষিয়ে নেয়ার কোন উপায় থাকে না। যেমন- জীব হত্যা মহাপাপ। কিন্তু কোন বিষধর সাপকে যদি কেউ মায়া করে ছেড়ে দেয় তাহলে সে সাপটিই তাকে কামড় দিয়ে হত্যা করতে দ্বিধান্বিত হবে না। কাজেই মোহ বা মায়া সর্বত্রই গ্রহণযোগ্যতা পায় না। একজন অধার্মিক বা মুর্খকে তার গুরুতর কোন অপরাধের পর নিঃশর্ত বা শুধু শুধুই ছেড়ে দিলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সে তার মূল্য রক্ষা করে না। কারণ সে মুর্খ বা মোহাবিষ্ট। সে তার নিজের সর্ম্পকে, সমাজ, পরিবেশ সম্বন্ধে জ্ঞানসম্পন্ন নয়।
মোহ রিপু থেকে মুক্তির উপায় ।
আত্মজ্ঞান,জ্ঞানীজনের উপদেশ,সৎসঙ্গ, সৎগুরু ও সাধুসঙ্গ ছাড়া মোহ রিপু থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। মানুষ মোহের বশবর্তী হয়ে যখন তার জীবন অতিবাহিত করে,তখন যদি সে কোন ভাবে তার মনের সামন্যতম অংশে সে মানুষ ও প্রকৃতিকে ভালবাসা ও ঈশ্বরকে পাওয়ার মোহ সৃষ্টি করতে পারে,তাহলে সে ধীরে ধীরে মোহ রিপু থেকে মুক্তি পায় এবং মানব জীবনে আসে পরম শান্তি ।
ষড় রিপুর পঞ্চম রিপু হলো মদ বা অহংকার।
অহংকার রিপু (arrogance/vanity)মদ রিপুঃ-
অহংকার হলো দম্ভ, গর্ব,দর্প,মদ্য, প্রমত্ততা, বিহবল ভাব ইত্যাদি। অহংকার রিপু হচ্ছে কাম-ক্রোধ-লোভের অতি মাত্রায় বহিঃ প্রকাশ। অহংকার মানুষকে তার প্রকৃত অবস্থা থেকে বিকৃত করে দেয় এবং তার আসল রূপটি লোপ পায়। অহংকারী মানুষদের অধিকাংশই আত্মশ্লাঘায় ভোগে। এই আত্মশ্লাঘা (নিজের প্রশংসা) তার নিজের মধ্যে নিহিত আত্মবোধ বা আত্মদৃষ্টিকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে সে পৃথিবীর সবকিছুই তুচ্ছ মনে করে ধরাকে সরাজ্ঞান করে থাকে। অহংকার জীবনের অর্জিত বা সঞ্চিত যাবতীয় সম্পদকে চোখের নিমেষে ধ্বংস করে দিতে পারে।
কথায় বলে- অহংকার পতনের মূল। অনেক সময় লক্ষ্য করা যায় যে, মানুষ অনেক সাধনা করে, ত্যাগ করে যা কিছু অর্জন করে তা সে অহংকারের কারণে ধরে রাখতে পারে না। তার অহংকার ধীরে ধীরে তাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। অহংকারী মানুষ আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য খুব বেশি পীড়াপীড়ি করে থাকে। সর্বত্রই চায় তার সর্বোচ্চ সাফল্য এবং তাতে আত্মঅহংকারে স্ফীত হয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার প্রাণান্ত চেষ্টায় বিভোর-বিহবল হয়ে পড়ে। ফলে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি তো পায়ই না; উপরন্তু হীন ও ক্ষুদ্র বলেই স্বীকৃতি পায়।
অহংকার রিপুর বশবর্তী মানুষের সাধারণত ইশ্বরে ভক্তি থাকে না, তার অতিদ্রুত মতিভ্রম ঘটে এবং এক পর্যায়ে মানুষের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হয়।
অহংকার রিপু থেকে মুক্তি পেতে হলে আত্মজ্ঞান,ইশ্বরে ভক্তি এবং বিশ্বাস প্রয়োজন। মনের মধ্যে ভাবা দরকার আমি জীবনে যা কিছু পেয়েছি তাহা সব ভগবানের কৃপায়। সমাজের উচুতলার ধনী লোকের দিকে নজর না দিয়ে, গরীব-দুঃখী ও শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধীদের দিকে গভীরভাবে মনযোগ নিবিষ্ট করলে ক্রমে-ক্রমে অহংকার রিপু থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এছাড়া অহংকার রিপু থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের বিশুদ্ধ (আসল) জ্ঞান কে বাড়াতে হবে কারণ প্রকৃত বা বিশুদ্ধ (আসল) জ্ঞান যত বাড়বে অহংকার তত কমবে এবং অসম্পূর্ণ বা অপ্রকৃত জ্ঞান (নকল জ্ঞান) যত বাড়বে অহংকার তত বাড়বে।
হিংসা রিপুঃ(envy/jealousy)-(মাৎসর্য্য রিপু)
হিংসার আভিধানিক অর্থ হলো ধ্বংসাত্মক ঈর্ষা,দ্বেষ,অনিষ্ট,পরশ্রীকাতরতা,বধ,হনন ইত্যাদি। কোনো পরিচিত বা নিকটজনের প্রশংসা শুনলে যদি যন্ত্রণা অনুভূত হয় এবং নিন্দা শুনলে যদি আনন্দ হয়। তাই হল ঈর্ষা এবং ধ্বংসাত্মক ঈর্ষা হল হিংসা। হিংসার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো পরশ্রীকাতরতা। পরশ্রীকাতরতা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে চরম অশান্তি ডেকে আনে। পরশ্রীকাতরতার তিনটি দিক রয়েছে।
এক-অন্যের ভাল কিছু দেখলে তার গা জ্বলে যাওয়া।
দুই -অপর কেউ ভাল কিছু করলে তার বিরোধিতা করা কিংবা ভাল কাজটির নেতিবাচক দিকগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে অন্যের সামনে হাজির করা।
তিন-বেঁকে বসা /অমান্য করা(উর্ধ্বতন এর বেলায় ): ঘৃণা করা /অবজ্ঞা করা (অধস্তনদের বেলায়) ।
হিংসা রিপুর বশবর্তী মানুষের মন হিংসার আগুনে দাউ দাউ করে প্রতিনিয়ত জ্বলতে থাকে। অন্যের ভাল সহ্য করতে না পারা এবং অতি আপন জনকেও অযথা সন্দেহের চোখে দেখা হিংসা রিপুর কাজ। হিংসা রিপুর বশবর্তী মানুষ অন্যের ভাল সহ্য করতে না পারার কারণে অপরের দুঃখে আনন্দিত হয়, অপরের আনন্দে হিংসা হয় এবং মনেমনে অপরের অনিষ্ট চিন্তা করে, কুট-কৌশলে অপরের ক্ষতি সাধন করে। হিংসা রিপুর বশবর্তী মানুষ মায়াবী কাল সাপের মতো। They are schadenfreude.
হিংসা রিপুর বশবর্তী মানুষ এতই কুটিল স্বভাবের হয় যে, সে অতি আপন জনের ভালও সহ্য করতে পারে না এবং তার ক্ষতি সাধন করতে দ্বিধাবোধ করে না। হিংসা রিপুর বশবর্তী মানুষের ধর্মে কর্মে বিশ্বাস থাকে না এবং জীবনে কোন কাজে দীর্ঘস্থায়ী সফলতা পায় না।
ছবি-ডাঃ পার্থ প্রতিম। |
হিংসা রিপু থেকে মুক্তির উপায় ।
আত্মজ্ঞান,জ্ঞানীজনের এবং সৎগুরুর উপদেশ,সৎসঙ্গ ও সাধু সঙ্গ ব্যতিত হিংসা (মাৎসর্য্য) রিপু কোন ভাবেই বশীভূত হয় না।
ঈর্ষা ও হিংসা:-
আভিধানিক অর্থে 'ঈর্ষা' আর 'হিংসা' প্রায় সমার্থক হলেও শব্দ দুটির প্রায়োগিক অর্থে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। ঈর্ষা ও হিংসা প্রায় একই রকমের আবেগ, তবে হিংসাকে বলা হয় ঈর্ষার চরম পর্যায় বা ঈর্ষার চরম বহিঃপ্রকাশ।
অর্থ, বিত্ত ,বুদ্ধি ,মেধা,রূপ ও সৌন্দর্য ইত্যাদি থেকেই যাবতীয় ঈর্ষার উৎপত্তি । নিজের যা আছে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা থেকেও ঈর্ষার জন্ম হয়,আবার তুলনা থেকেও ঈর্ষার জন্ম হয়। কিছু হারানোর আশঙ্কায় অস্বাভাবিক এবং অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়াও হলো ঈর্ষা, আর এই প্রতিক্রিয়া যখন মনে অন্যের ক্ষতি করার ইচ্ছে তৈরী করে, তখন তা হলো ধ্বংসাত্মক ঈর্ষা বা হিংসা।
ঈর্ষা থেকে মুক্তির উপায় ।
ঈর্ষা থেকে মুক্তির জন্য সুস্থ সমাজ, সমবণ্টন ও সুস্থ পরিবেশ প্রয়োজন। চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমতা রাখাটাও জরুরি।এছাড়া নিজের বোধ,বিবেচনা,বুদ্ধি দিয়ে বাস্তবের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারলে ঈর্ষাকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
এছাড়া
ষড়রিপুর প্রভাব,ষড়রিপু কে নিয়ন্ত্রণ বা দমন করার জন্য আমাদের মন কে শান্ত ও পরিষ্কার রাখতে হবে, তার কারণ মন হলো জলের মতো ,মনে খারাপ চিন্তা এলে মন নর্দমার মতো নোংরা হয়ে যায় ,কিন্তু যদি মনে ভালো চিন্তা আসে তাহলে সেটি গঙ্গা জলের মতো পবিত্র হয়ে যায়।
মানব জীবন এবং ষড়রিপু।
মানব জীবন বড়ই বিচিত্র । জীবনে নানা ঘাত প্রতিঘাত জীবনকে প্রতিনিয়ত যেমনি শুধরিয়ে দেয় তেমনি আবার কলুষিত ও করে থাকে। আমাদের জীবনে চলার পথে ষড়রিপু প্রতিনিয়ত ক্রিয়াশীল। প্রতিটি মুহূর্ত আমাদেরকে ষড়রিপুর মুখোমুখি হতে হয়। জ্ঞানী মানুষ ষড়রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করে মনকে শুদ্ধ করে এবং তার মাধ্যমে দেহ শুদ্ধ করে ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিয়ে মানব থেকে মহামানব হয়ে যাচ্ছেন অথচ অজ্ঞানী মানুষ হাবুডুবু খাচ্ছেন ষড়রিপুর ভয়াল গ্রাসে। আর এই অজ্ঞানী মানুষ গুলি যখন পৌঁছান তাঁদের জীবনের অন্তিম পর্যায়ে এবং জীবনের শেষ অঙ্কটি মেলাতে চেষ্টা করেন ,তখন তারা ভাবেন জীবন অঙ্ক টা কে মেলাতে গিয়ে কে পেলাম শুধু শূন্য দিয়ে ভরে গেলাম।
তাই আমাদেরকে বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ভাবতে হবে, নিরীক্ষণ করতে হবে জগত ,জীবন ও সত্য কে। আমাদের চাইতে হবে সত্য ও সুন্দরকে, আর মনে রাখতে হবে,আমাদের মানব জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য অর্থ উপার্জন এবং ভোগবিলাস নয় এর প্রধান উদ্দেশ্য হল মুক্তি অর্থাৎ জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি তাই আমাদের মনে রাখতে হবে ''কাজ করো বুদ্ধি দিয়ে,জীবন যাপন করো শুদ্ধি দিয়ে''।
আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের শরীর একটি ভাড়া ঘরের মতো ,সময় হলেই আমাদের এই শরীর কে ছেড়ে অন্য শরীরের আশ্রয় নিতে হবে এটাই পরম সত্য। অথচ মানুষের মনের মধ্যে মধ্যে লুকিয়ে থাকা ষড়রিপুর মধ্যে মোহ রিপু মানুষকে এই সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং কাম-ক্রোধ-লোভ -মদ (অহংকার)-মাৎসর্য্য (হিংসা ) এই পাঁচ টি রিপু মানুষকে অধোগামী করে এবং প্রবল আকার ধারণ করলে মানুষকে নরকে নিক্ষেপ করে। তাই মানব জীবনের আসল উদ্দেশ্য প্রাপ্তির জন্য ষড়রিপুর উপর নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক যার জন্য ,মানব জীবনে অটুট সংযম, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও কঠোর পরিশ্রম (সাধনার ) প্রয়োজন। সংযম সাধনার মাধ্যমেই ষড়রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের শরীর একটি ভাড়া ঘরের মতো ,সময় হলেই আমাদের এই শরীর কে ছেড়ে অন্য শরীরের আশ্রয় নিতে হবে এটাই পরম সত্য। অথচ মানুষের মনের মধ্যে মধ্যে লুকিয়ে থাকা ষড়রিপুর মধ্যে মোহ রিপু মানুষকে এই সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং কাম-ক্রোধ-লোভ -মদ (অহংকার)-মাৎসর্য্য (হিংসা ) এই পাঁচ টি রিপু মানুষকে অধোগামী করে এবং প্রবল আকার ধারণ করলে মানুষকে নরকে নিক্ষেপ করে। তাই মানব জীবনের আসল উদ্দেশ্য প্রাপ্তির জন্য ষড়রিপুর উপর নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক যার জন্য ,মানব জীবনে অটুট সংযম, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও কঠোর পরিশ্রম (সাধনার ) প্রয়োজন। সংযম সাধনার মাধ্যমেই ষড়রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
আমাদের ধর্মগ্রন্থ ও জীবন দর্শন গুলোর অন্যতম উপদেশ হলো কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্যকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং আমাদের ধর্মগ্রন্থ ও জীবন দর্শন গুলোর মতে জীবনে সুখ, শান্তি, মহৎ কার্য সম্পাদন, সৃজনশীলতা এবং মানব জীবনের চরম উদ্দেশ্য ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্য ষড়রিপুর নিয়ন্ত্রণ এবং দমন অত্যন্ত আবশ্যক । আসুন আমরা সবাই কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্যকে নিয়ন্ত্রণ করি এবং জীবনে সুখ, শান্তি, মহৎ কার্য সম্পাদন, সৃজনশীলতা এবং মানব জীবনের চরম উদ্দেশ্য ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্য প্রয়াস করি এবং মন কে শান্ত রাখার জন্য ঈশ্বরের শ্রী চরণ যুগল কে স্মরণ করে সুমধুর নাম সংকীর্তন শ্রবণ করি।
সনকাদি ঋষিদের এক অলৌকিক
মন্ত্র - হরি স্মরণম ।
ষড়রিপুর উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। ষড়রিপুর উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পাওয়া খুবই জটিল। মহর্ষি বিশ্বামিত্র ৬০ হাজার বছর তপস্যা করেও ষড়রিপুর উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে অপ্সরা মেনকা র প্রেমে পড়েছিলেন। ষড়রিপুর উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ একমাত্র শ্রী হরির চরণ কমল এর ধ্যান এর মাধ্যমে ই সম্ভব। মহারাজ অম্বরীষ শ্রী হরির চরণ কমল এর ধ্যান এর মাধ্যমে ই মহর্ষি দুর্বাশার ক্রোধ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। শ্রী হরির চরণ কমল এর ধ্যান করেই হাজার হাজার মহান আত্মা,প্রভুর সান্নিধ্য লাভ করেছেন এবং জন্ম চক্র থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
লেখকের মন্তব্য:-
এই নিবন্ধটি ভগবান জগন্নাথের ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণায় লেখা হয়েছে। যদি কেউ বা কোনও সংস্থা এই নিবন্ধের কোনও বিষয়বস্তুর সাথে একমত না হন তবে তিনি বা তারা এটিকে দলিল প্রমাণ সহ মন্তব্যে উল্লেখ করতে পারেন এবং এটি সংশোধন করা হবে। ডকুমেন্টারি প্রমাণ এবং তথ্যের উৎস ছাড়া এই বিষয়ে যে কোনও মন্তব্যকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং অসাধু বলে গণ্য করা হবে ।
আর্টিকেল টি কে সহজ সরল ভাবে বোঝানোর জন্য এমন কিছু শব্দ এবং ছবি চয়ন করা হয়েছে ,যা সাধারণ ভাবে বাঞ্চনীয় নয়,কিন্তু বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থা ,সামাজিক পরিবর্তন কে দেখে এবং পথ ভ্রষ্ট মানুষ কে পথে আনার জন্যই এই শব্দ এবং ছবি চয়ন করা হয়েছে । সমগ্র মানব জাতি ও জীব জন্তুর কল্যাণ হোক। শান্তির জয় হোক,সত্যের জয় হোক,মানবতার জয় হোক , ধর্মের জয় হোক। 🙏হে প্রভু আমাকে শুধু জ্ঞান দাও ,ভক্তি দাও আর শক্তি দাও🙏
লেখক পরিচিতি:- প্রবীর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উৎকল ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রবীরের বইগুলি Amazon.com. flipkart.com, abebooks.com এর মাধ্যমে বিক্রি হয়। গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিন থেকে সার্চ করে এখনো পর্যন্ত ১২ লাখের বেশি লোক প্রবীরের লেখা আর্টিকেল গুলি পড়েছেন।