ভীম একাদশী ও দক্ষিণ বঙ্গের ভৈম-একাদশীর ব্রত পালন।





মাঘ মাসের শুক্লা একাদশীতে দক্ষিণ বঙ্গের একটি বহুপ্রচলিত গ্রাম্যরীতি হল ভৈম-একাদশীর ব্রত পালন । মহাভারতের ভীম এবং একাদশীর এই যোগসূত্র কি  সেই নিয়ে এই আলোচনা।যদিও এই বিষয়ে নানা মুনির নানা মত। তাই পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত একটি মতের  কথা উল্লেখ করছি। 
হিন্দুঘরের বিধবা কুন্তী স্নান করে একাদশীর উপবাস করেন । মাঘ মাসের প্রচন্ড ঠান্ডায় পুকুরের ঠান্ডাজলে কেমন করে স্নান করবেন তা ভেবে পান না । কিন্তু সাতপাঁচ ভেবেও ঐ ঠান্ডা জলে তাঁকে নামতে হ'ল । স্নান সেরে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে কুন্তী ঘরের দিকে আসার পথে তাঁর মধ্যমপুত্র ভীমের সাথে দেখা হল । ঠান্ডায় কাবু মা'কে দেখে শীতের ওপর ভীমের খুব রাগ হ'ল  । মায়ের কষ্ট তাঁর সহ্য হচ্ছিল না। তখন ভীম লাঙ্গল থেকে ফাল খুলে নিয়ে আগুণে কশকশে করে গরম করে "জয় শ্রী কৃষ্ণ" বলে সেই লাঙ্গলের ফালকে পুকুরের ঠান্ডা জলে ডুবিয়ে দিলেন । আর দেখতে দেখতে যেন শীত পালিয়ে গেল।পান্ডবসখা শ্রী কৃষ্ণ ভক্ত ভীমের মনস্কামনা পূর্ণ করলেন । হঠাৎ ভীম মায়ের দিকে চেয়ে দেখেন, কুন্তী খুব আরাম বোধ করছেন ।
এদিকে জলের দেবতা হলেন বরুণদেব।পুকুরের জলে আগুনে গরম লাঙলের ফাল ডুবিয়ে জলের গরম তাপ সহ্য হয়নি একটুও তাঁর। বরুণদেব সেই রাগে দ্বারকায় গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের কাছে দৌড়ে গেলেন পুকুরের জলের তাপ জুড়ানোর আর্জি নিয়ে। কৃষ্ণের পায়ে লুটিয়ে পড়লেন বরুণদেব।কৃষ্ণের দয়া হল । 
কৃষ্ণ বললেন : বরুণ তোমার গায়ের জ্বালা জুড়োনোর একটাই উপায় । মাঘমাসের শুক্লা একাদশীতে ভীম যদি এই ব্রতের পালন করে তবে তোমার জ্বালা জুড়োবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি জনিত দেহতাপ কমে যাবে।
এই কথা শোনামাত্র শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করে বরুণদেব দৌড়ে গেলেন ভীমের কাছে।বনের মধ্যে দেখা হল ভীমের সাথে। একাদশীর ব্রতের কথা ভীম অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। তাপদগ্ধ বরুণদেবের গাত্রজ্বালা উপশম হল। 


কাশীরাম দাস অনুদিত মহাভারতের অনুসারে
মহাভারতের ভীম নাকি দক্ষিণবঙ্গে বেশ কিছুদিন ঘুরে বেড়িয়েছিলেন।
পঞ্চপান্ডব এই গহীন অরণ্যের মধ্য দিয়ে বনবাসে চলেছিলেন।সে কথার উল্লেখ কাশীরাম দাস অনুদিত মহাভারতে পাওয়া যায়। কুন্তী পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতে বসলেন সেই জঙ্গলেই।আর সেখানেই উপজাতি পরিবারের রাক্ষস হিড়িম্ব আর তার বোন হিড়িম্বা এসে উপস্থিত হল।মহা উল্লাসে নরখাদক হিড়িম্ব তার কাজ সারতে পঞ্চপান্ডব সহ মাতা কুন্তীকে সংহার করতে উদ্যত হল আর মহাবলী ভীমসেন তার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন।হিড়িম্বকে বধ করে ভীমসেন তার দেহ রেখে এলেন খড়গেশ্বর শিবের মন্দিরের সামনে আর হিড়িম্বা রাক্ষসীর সাথে তার পর ভীমের প্রণয় ও গন্ধর্ব মতে তাকে বিয়ে।স্থানীয় মানুষরা বিশ্বাস করেন প্রাচীনকালে "মেদ" উপজাতির বাসভূমি হিসেবে মেদিনীপুর ভূখন্ডর নাম এই ঘটনার সাক্ষী বহন করছে খড়গেশ্বর ও তার অনতিদূরেই হিড়িম্বেশ্বরী কালীর মন্দির যা পুজো করতেন মহাভারতের ভীমের পত্নী হিড়িম্বা। হিড়িম্বার সাথে এইখানেই তার আলাপ।তাই ভীমের পুজো করার জন্যই ঐ অঞ্চলের গ্রামবাসীরা ভীম-একাদশীর ব্রত পালন করেন। 
এই প্রচলিত গল্পের মধ্য দিয়ে আমরা যেমন দেখি ভীমের মাতৃভক্তি ঠিক তেমনি দেবলোকেও দেবতাদের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিপত্তি । 
বাংলার লোকসংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে ভীমপুজোয় এই বিপুল আয়োজন আর আড়ম্বর হয় এখানে।দশাস‌ই ভীমসেনের এই মূর্তি যেন মেলার একাই একশো। মাথাভর্তি কুঞ্চিত কেশ, শ্বশ্রূগুম্ফ সম্বলিত পৌরুষ যেন চিরন্তন বীরত্বের প্রতীক । কোথাও ইনি ভীমসেন, কোথাও বা খেত্তী ভীম, হালুয়া ভীম আবার কোথাও হুলা ভীম কিম্বা চাষী ভীম । কিন্তু সেই মহাভারতের মধ্যমপান্ডব স্থান-কাল-পাত্রভেদে যুবশক্তির বহিঃপ্রকাশ।আর সর্বোপরি ভীমের এই পুজো যেন সমগ্র দক্ষিণবাংলার কৃষিপুজো কারণ তিনি তো আদতে পবনপুত্র ।বায়ু আর বৃষ্টির হাত ধরে উর্বর হবে বাংলার মাটি। সবুজে সবুজ হয়ে উঠবে আবাদীজমি এই আশায় গাঁয়ের মানুষের এই বিশ্বাস।
এখন প্রশ্ন হল দক্ষিণবঙ্গে কেন ভীমপুজোর এত জনপ্রিয়তা? কৃষি ছাড়াও এখানকার বন্দর নগরী তমলুকে একসময় বহু জাহাজের সমাগম হত। চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙার মত অনেক ব্যবসায়ীর পণ্যবোঝাই জাহাজ এসে ভিড়ত হলদিয়া বন্দরে । আবার রফতানিও হত ভারতীয় সামগ্রী। বাতাসের আনুকুল্যে নিরাপদে, নির্বিঘ্নে যাতে জাহাজ যাত্রা বা আগমন সফল হয় এবং জাহাজ যাত্রা যাতে শেষযাত্রা না হয় এবং জলদস্যুর আক্রমণের মুখে না পড়ার উদ্দেশ্যে ভীমের পুজো করে পাঠানো হত জাহাজগুলিকে । তাই সেই কারণে দক্ষিণবঙ্গে এই পবনপুত্রের ওপর ব্যবসায়ীদের ছিল প্রগাঢ় আস্থা ।

সবাই ভালো থাকুন ,সুস্থ থাকুন। সমগ্র মানব জাতি ও জীব জন্তুর  কল্যাণ হোক। শান্তির জয় হোক,সত্যের জয় হোক,মানবতার জয় হোক ,সনাতন ধর্মের জয়  হোক। 🙏হে প্রভু আমাকে শুধু জ্ঞান দাও ,ভক্তি দাও আর শক্তি দাও🙏













আমি এই আর্টিকেল টি আমার এক মাত্র
 ছেলে  ৺ >আকাশের< জন্য উৎসর্গ করিলাম।
Appreciation Mail of  Jérémie Lumbroso
lecturer Princeton University. USA


 প্রবীর  ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের  উৎকল ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।  প্রবীরের  বইগুলি Amazon.com. flipkart.com, abebooks.com এর মাধ্যমে বিক্রি হয়। গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিন থেকে সার্চ করে এখনো পর্যন্ত ১২ লাখের বেশি লোক  প্রবীরের লেখা আর্টিকেল গুলি পড়েছেন।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সত্য,ত্রেতা,দ্বাপর,কলি এই চার যুগের সময়,পরিমাণ,বৈশিষ্ট্যসমূহ ও অবতার এবং যুগ পরিবর্তন ও কল্কি অবতার।

ষড়রিপু এবং মানব জীবনে ষড়রিপুর প্রভাব:ষড়রিপু কে নিয়ন্ত্রণ বা দমন করার উপায়।

আরতি কি ? আরতি কি ভাবে করবেন ? সন্ধ্যা দেওয়ার নিয়ম কি ? পড়ুন এবং দেখুন ।