দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা ।
বিশ্বকর্মা। বিষ্ণু পুরাণ মতে,বিশ্বকর্মা একজন দেবশিল্পী। তাঁর মাতার নাম যোগসিদ্ধা পিতার নাম প্রভাষ। প্রভাষ হচ্ছেন অষ্ট বসুর মধ্যে সপ্তম বসু। অষ্টবসু মানে আটজন গণদেবতা। তাঁরা হলেন ধর, ধ্রুব, সোম,অনিল, অনল, প্রত্যুষ, প্রভাষ ও দ্যু। এই অষ্টবসু দক্ষরাজার কন্যা বসুর পুত্র । হিন্দু শাস্ত্রে নয় শ্রেণীর গণদেবতার উল্লেখ রয়েছে । এদের মধ্যে অষ্টবসু অন্যতম ।অন্যরা হলেন নিম্নরুপঃ
১.আদিত্য ১২ জন,
২. বিশ্বদেব ১০ জন,
৩. বসু ৮ জন,
৪. তুষিত ৩৬ জন,
৫. আভাশ্বর ৬৪ জন,
৬. অনিল ৪৯ জন,
৭. মহারাজিক ২২০ জন,
৮.সাধ্য ১২ জন ও
৯. রুদ্র ১১ জন।
নয় শ্রেণীর গণদেবতা সকলেই শিবের অনুচর। এই নয় শ্রেণীর গণদেবতার নেতা হচ্ছেন গণেশ।
বিশ্বকর্মার মাতার নাম যোগসিদ্ধা। যোগসিদ্ধা হচ্ছেন দেবগুরু বৃহস্পতির বোন।বৃহস্পতি ও শুক্র দুই ভাই। ব্রহ্মা তনয় কশ্যপ ঋষির ঔরসে অদিতির গর্ভের সন্তান বৃহস্পতি এবং কশ্যপ ঋষির ঔরসে দিতির গর্ভের সন্তান শুক্র। বৃহস্পতি দেবতাদের গুরু এবং শুক্র অসুরদের গুরু। দেবতা ও অসুর কোন পৃথক জাতি নয়। মহাভারত ও পুরাণ মতে,তারা একই পিতার ঔরসজাত সন্তান। কশ্যপের অপর পত্নী দনুর গর্ভজাত সন্তান দানব। দেবতাদের সন্তান প্রসব একটি জ্যোতি মাত্র। এই জ্যোতি নাভি স্পর্শ হলেই সঙ্গে সঙ্গে সন্তান প্রসব হয়।
ঋকবেদে উল্লেখ আছে যে,বিশ্বকর্মা সর্বদর্শী ভগবান। তাঁর চক্ষু, মুখমন্ডল, বাহু ও পদদ্বয় সর্বদিক ব্যাপিয়া রয়েছে। বাহু ও পদদ্বয়ের সাহায্যে তিনি স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল অর্থাৎ ত্রিভুবন নির্মাণ করেছেন।বিশ্বকর্মা শিল্প সমূহের প্রকাশক,অলঙ্কারের স্রষ্টা এবং দেবতাদের বিমান ও রথ নির্মাতা। তাঁর অশেষ কৃপায় মানবজাতি শিল্প কলায় পারদর্শিতা লাভ করেছে। উপবেদ, স্থাপত্যবেদ এর রচয়িতা এবং চতুঃষষ্ঠী কলার অধিষ্ঠাতা হচ্ছেন বিশ্বকর্মা।
তিনি প্রাসাদ, ভবন, উদ্যান প্রভৃতির শিল্প প্রজাপতি। বিশ্বকর্মা কেবল দেবশিল্পীই নন,তিনি দেবতার অস্ত্রাদিও নির্মাণ করেছেন। সকল আগ্নেয়াস্ত্র তাঁরই নির্মিত। মহাভারত মতে তিনি শিল্পের শ্রেষ্ঠকর্তা, সহস্র শিল্পের আবিষ্কারক এবং সর্বপ্রকার কারুকার্য নির্মাতা।
তিনি প্রাসাদ, ভবন, উদ্যান প্রভৃতির শিল্প প্রজাপতি। বিশ্বকর্মা কেবল দেবশিল্পীই নন,তিনি দেবতার অস্ত্রাদিও নির্মাণ করেছেন। সকল আগ্নেয়াস্ত্র তাঁরই নির্মিত। মহাভারত মতে তিনি শিল্পের শ্রেষ্ঠকর্তা, সহস্র শিল্পের আবিষ্কারক এবং সর্বপ্রকার কারুকার্য নির্মাতা।
পুরাণ অনুসারে বিশ্বকর্মা রাক্ষসপুরী লঙ্কা নগরীর নির্মাতা। নল নামধারী বানর বিশ্বকর্মার পুত্র। বিশ্বকর্মা দেবতাদের পুষ্পক রথের নির্মাতা, আগ্নেয়াস্ত্রের স্রষ্টা, শ্রীবিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, শিবের ত্রিশূল, লক্ষ্মীর কোষাধ্যক্ষ, কুবেরের কুবের পাস, পঞ্চপান্ডবের ইন্দ্রপ্রস্থ নগরী তৈরি এবং শ্রী ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ জগন্নাথের বিগ্রহ নির্মাতা, সহস্র শিল্প বিদ্যার অধিকারী বিশ্বকর্মা যবিষ্ঠ বা অগ্নিরূপে বর্ণিত।
তাঁর হস্তীবাহন মূর্তির হাতে হাতুড়ির সঙ্গে মশালও রয়েছে । বিশ্বকর্মা সৃষ্টিশক্তির রূপক নাম। তিনি ধাতা, বিশ্বদ্রষ্টা ও প্রজাপতি। তিনি পিতা, সর্বজ্ঞ দেবতাদের নামদাতা এবং মর্ত্যজীবের অনধিগম্য।বিশ্বকর্মা সর্বমেধ যজ্ঞে নিজেকে নিজের কাছে বলি দিয়েছেন। তিনি বাচস্পতি, বদান্য, কল্যাণ কর্মা ও বিধাতা। কোন এক পুরাণ মতে, বিশ্বকর্মা বৈদিক ত্বষ্টা দেবতাদের কর্মশক্তিও আত্মসাৎ করেছিলেন। এইজন্য তিনি ত্বষ্টা নামেও অভিহিত। বৈদিক দেবতা ত্বষ্টার বিভিন্ন গুণ ছিল। বিশ্বকর্মা নিজেরকন্যা সূর্যা সংজ্ঞা( সূর্যা ) সূর্যের সঙ্গে বিবাহ দেন। রামায়ণ ও মহাভারত মতে, সূর্য হচ্ছেন কশ্যপ ঋষির ঔরসে অদিতির গর্ভের সন্তান। অদিতির নাম অনুসারে সূর্যের আরেক নাম আদিত্য। সূর্যা ( সংজ্ঞা ) সূর্যের প্রখর তাপ সহ্য করতে পারেন নাই, তাই সংজ্ঞার পিতা বিশ্বকর্মা শান চক্র স্থাপনকরে সূর্যের উজ্জ্বলতার এক অষ্টমাংশ কর্তন করেন। এই কর্তিত অংশ পৃথিবীর ওপর পতিতহলে উক্ত অংশের দ্বারা বিশ্বকর্মা দেবতাদের বিভিন্ন অস্ত্র তৈরি করে দিয়েছেন।
বিশ্বকর্মা পূজা
বিশ্বকর্মা পূজা ভাদ্র সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয়। ভাদ্র সংক্রান্তিতেই কেন তার পূজা করা হয় এ সম্পর্কে বৃহৎ সংহিতাতে উল্লেখ রয়েছে,গ্রীষ্মের শেষে সূর্য মেঘ রচনা করে কর্মের মাধ্যমে বিশ্বের কর্ম অর্থাৎ কৃষি সংরক্ষণ করেন। তাই তিনি হচ্ছেন বিশ্বকর্মা। ভাদ্র মাসের শেষের দিকে বর্ষা শেষ হয়ে যায়।তখন কৃষি কর্মের পূর্ণতা হয় এবং তখন কৃষকেরা ফসলের জন্য প্রতিক্ষা করেন। তাই সেই কর্ম ক্ষান্তিতে অর্থাৎ ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে তাঁকে পূজা করে কৃতজ্ঞতা নিবেদন করেন। এমতাবস্থায় দেখা যায়,বিশ্বকর্মা শুধু শ্রমিকের নয়, কৃষকদেরও উপাস্য দেবতা। বিশ্বকর্মা শুধু দেবশিল্পী নন, তিনি মর্ত্যবাসী মানবদেরও শিল্প প্রজাপতি। তাঁর আশীর্বাদে মর্ত্যবাসীগণ শিল্পকাজে যথেষ্ট পারদর্শী হয়েছেন। তিনি বর্তমান শ্রীলঙ্কা নগরীর নির্মাতা এবং পঞ্চপান্ডবের প্রাসাদও নির্মাণ করেছেন। তাই দেবশিল্পী বিশ্বকর্মাকে পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তারূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ঋকবেদেও বিশ্বকর্মাকে সর্বদর্শী ভগবান বলা হয়েছে।
বিশ্বকর্মা যে শুধু কর্মে সুদক্ষ তা নয়, তিনি বেশ কিছু গ্রন্থও লিখে রেখে গেছেন উত্তরসূরীদের জন্য। বিশ্বকর্মার রচিত স্থাপত্যশিল্প বিষয়ক গ্রন্থটির নাম “বাস্তুশাস্ত্রম”। “মানসার” এবং “ময়মতম” গ্রন্থে বস্তু ও বাস্তু শব্দদুটিকে সমার্থক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ‘বস্তু’ শব্দ থেকে ‘বাস্তু’ কথাটা এসেছে। ‘বাস্তু’ শব্দের অর্থ পৃথিবী। ব্যাপক অর্থে সমস্ত প্রাণীর আবাসস্থলই বাস্তু। অর্থাৎ, স্রষ্টার যে-কোনো সৃষ্টিই বাস্তু। কাজেই শুধু পরিকল্পিত মনুষ্যগৃহই নয়, দেবতা থেকে শুরু করে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর আবাসকেই বাস্তু বলে। বাস্তুশাস্ত্রে বাস্তু শব্দের অর্থ ব্যাপক। এই শিল্পকে নির্মাণ শিল্পকে না-বুঝিয়ে পরিকল্পনা, নির্মাণ, চিত্র, অলংকরণ, স্বর্ণ-চর্ম-বয়নশিল্প, অস্ত্রশিল্প, পোতনির্মাণ, মূর্তিনির্মাণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত আছে।
পুরাণে উল্লেখ আছে, চারটি বেদের মতো চারটি উপবেদও আছে। উপবেদগুলি হল আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গান্ধর্ববেদ এবং স্থাপত্যবেদ। এই স্থাপত্যবেদ উপবেদ বা স্থাপত্যবিদ্যা বা বাস্তুবিদ্যার রচয়িতা হলেন বিশ্বকর্মা। বলা হয় তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রধান বাস্তুকার। তাঁর রচিত অন্তত দশখানি পুথি এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। অন্যদিকে মৎস্যপুরাণের ২৪২ থেকে ২৪৭ অধ্যায়, অগ্নিপুরাণের ১০৪ থেকে ১০৬ অধ্যায়, গরুড়পুরাণের ৪৬ থেকে ৪৭ অধ্যায়, ভবিষ্যপুরাণ, বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণের তৃতীয় খণ্ড, বিভিন্ন আগম, শুক্রনীতিসারের চতুর্থ অধ্যায়, বৃহসংহিতা, গৃহ্যসূত্র, অর্থশাস্ত্র প্রভৃতিতে বাস্তুশাস্ত্রের আলোচনা পাওয়া যায় । ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় গণপতিশাস্ত্রী বাস্তুবিদ্যা বা বাস্তুশাস্ত্রম গ্রন্থটি আবিষ্কার করে মুদ্রিত করেন। বিশ্বকর্মার নামে প্রচলিত বাস্তুশাস্ত্রটির নাম “বিশ্বকর্মাবাস্তুশাস্ত্রম”। আর্যাবর্তের শিল্পধারা বিশ্বকর্মার দ্বারা প্রবর্তিত বলে মনে করা হয়। বিশ্বকর্মার “বাস্তুশাস্ত্রম”-এর প্রথমেই বলা হয়েছে, জগতের কল্যান কামনায় এই শাস্ত্র প্রচার করছেন – “বাস্তুশাস্ত্রং প্রবক্ষ্যামি লোকানাং হিতকাম্যয়া”। বিশ্বকর্মার নামে এরকম গ্রন্থ অন্ততপক্ষে দশটি পাওয়া গেছে।
কী আছে “বাস্তুশাস্ত্রম” গ্রন্থটিতে? সুপরিকল্পিতভাবে গৃহনির্মাণ, গ্রাম ও নগরের পত্তনের নিয়মাবলি এবং বিধিনিষেধ তাঁর গ্রন্থটিতে পাওয়া যায়।
বিশ্বকর্মা রচিত এই গ্রন্থে গৃহ, মন্দির, গ্রাম, নগর, যন্ত্র প্রভৃতির বর্ণনা দেখতে পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের প্রধান আলোচ্য বিষয় হল – (১) সর্বপ্রথম গৃহারম্ভের কাল পরীক্ষা, উপকরণ সংগ্রহ, জমি পরীক্ষা, বিভিন্ন দিক নির্ণয়, ভবন লক্ষণ প্রভৃতি বিভিন্ন পরিচ্ছেদে আলোচিত হয়েছে। (২) বাসযোগ্য গৃহ ছাড়াও বিদ্যালয়, চিকিৎসালয়, সর্বসাধারণের ব্যবহার্য গৃহ, পাকশালা, শৌচাগার, পুষ্করিণী, উদ্যান প্রভৃতি কোনদিকে থাকবে, আলো-বাতাস প্রবেশের কীরকম হবে, সবই সুন্দরভাবে আলোচিত হয়েছে। (৩) বিশ্বকর্মার খ্যাতি পুরাণাদিতে দেবশিল্পী হিসাবে পাওয়া যায়। বিভিন্ন মন্দির ও তার উপকরণ প্রভৃতির বিস্তৃত আলোচিত হয়েছে। মন্দিরের কাজে ব্যবহারের জন্য আট প্রকার কাঠ এবং সাধারণ গৃহস্থদের গৃহনির্মাণের জন্য তেইশ প্রকারের কাঠের ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। কাঠগুলি কাটার পর পনেরো দিন জলের মধ্যে ভিজিয়ে রাখলে তাতে পোকা ধরবে না। এই প্রসঙ্গে বিশ্বকর্মা লিখেছেন – “কাষ্ঠং নো ভক্ষ্যতে কীটের্যদি পক্ষং ধৃতং জলে”।(৪) দেওয়ালের প্রস্থ ও উচ্চতা, ভিতের গভীরতা, দরজা ও জানালার পৃথক পৃথক মাপের বর্ণনাও এই গ্রন্থটিতে পাওয়া যায়।ভারতীয় স্থাপত্যশিল্পের ইতিহাসে বিশ্বকর্মার “বাস্তুশাস্ত্রম” গ্রন্থটি এক অমূল্য সম্পদ ।
This article has been penned under the divine inspiration of Lord Jagannath. If anybody or any organization doesn't agree with any content of this article, he or they may mention it in the comments with documentary evidence and it will be corrected. Any comments in this regard without documentary evidence and source of Information will be treated as mala fide and will be deleted.