গোবর্ধন পূজা ,অন্নকূট মহোৎসব ও বাঁধনা পরব।
গিরি গোবর্ধন পূজা ,অন্নকূট মহোৎসব ও বাঁদনা বা বাঁধনা পরব।
পৌরাণিক কাহিনি। প্রত্যেক বছর বৃন্দাবনবাসীরা বৃষ্টির দেবতা দেবরাজ ইন্দ্রের পূজা করতেন । গোকুলে থাকার সময়ে কৃষ্ণ একবার বৃন্দাবনবাসীদের দেবরাজ ইন্দ্রের পূজা করতে নিষেধ করেন। তাই কৃষ্ণের উপদেশ অনুসারে তারা সেই বছর ইন্দ্রের পূজা বন্ধ করে দেন। এতে দেবরাজ ইন্দ্র রেগে গিয়ে বৃন্দাবনের উপরে মুষলধারে বর্ষণ করেন। বৃন্দাবনবাসীদের ওই বিপদ থেকে রক্ষার জন্য কৃষ্ণ গিরিধারীরূপে গোবর্ধন পর্বতকে উপরে ছাতার মতো করে ধারণ করলেন এবং বৃন্দাবনবাসীরা তার নিচে তাদের গাভী দের নিয়ে আশ্রয় নিলেন। । ইন্দ্র পরাজিত হন। অহংকারী ইন্দ্র লজ্জিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ পদে আত্মনিবেদন করলেন। তার পর থেকে কৃষ্ণের নির্দেশে বৃন্দাবনবাসীরা কার্তিক মাসে অমাবস্যার পরদিন ‘গিরি গোবর্ধন’পূজা ও গরু গাভীদের পূজা আরম্ভ করেন। সেই পূজাই গোবর্দ্ধন পূজা / অন্নকূট উৎসব। এই অনুষ্ঠান থেকেই গোবর্দ্ধন পূজা / অন্নকূট মহোৎসবের সূচনা।
এদিন থেকেই গিরি গোবর্দ্ধন পূজার সাথে গোমাতার (সুরভি /কামধেনু) পূজা ও গো বন্দনা করা হয় । এদিন গরু গাভীদের গায়ে বিভিন্ন প্রকারের রং ও আলতা দিয়ে ছাপ দেওয়া হয়,হলুদ জলে পা ধোয়ান হয় । গরু, গাভীদের শিঙে তেল দেওয়া হয়, গোয়াল ঘরে আলপনা দেওয়া হয় এবং পূজা করা হয়।। বেদে এই পূজা কে পশুঘ্ন্য যজ্ঞ বলা হয়েছে কালান্তরে এর নাম হয়েছে গোপূজা বা গোবন্দনা। এই পূজা ভারতবর্ষের হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি প্রধান পূজা । হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে এই পূজা অত্যন্ত জাকঁজমকে পালিত হয়।
বাঁধনা বা বাঁদনা পরব ।
বাঁকুড়া,পুরুলিয়া ,উত্তর পশ্চিম মেদিনীপুর,ধলভূম,মানভূম অঞ্চলে এই উৎসবের অন্য এক নাম বাঁধনা। অনেক গবেষকদের মতে গো বন্দনা থেকে বন্দনা, বন্দনা থেকে বাঁদনা বা বাঁধনা শব্দটি এসেছে । এটি বাঁকুড়া ,পুরুলিয়া ,মেদিনীপুর এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাসরত উৎকল ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের একটি প্রধান উৎসব। এই দিন উৎকল ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে গিরি গোবর্দ্ধন পূজার সাথে গোমাতার (সুরভি /কামধেনু) পূজা ও গোয়াল ঘরে গো বন্দনা করা হয় ।
বাংলা উইকিপেডিয়া থেকে জানা যায়।
বাঁধনা পরব বা বাঁদনা পরব ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্য এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলার কুড়মি, ভূমিজ, লোধা প্রভৃতি জনজাতির কৃষিভিত্তিক উৎসব। প্রতি বছর কার্তিক মাসের অমাবস্যার রাত্রে অনুষ্ঠিত কালীপূজার পরদিন বাঁধনা পরব পালিত হয়ে থাকে। এই উৎসবে যে গান গাওয়া হয়, তাকে অহীরা গান বলা হয়।
লোক কথা:-একবার পৃথিবীর সমস্ত গাই গরুরা ভগবান শিবের কাছে নালিশ করলেন যে পৃথিবীর মানুষরা তাঁদের খেয়াল রাখেন না , অনেকেই তাঁদের সাথে দুর্ব্যবহার করেন ,তখন ভগবান শিব বললেন তিনি সয়ং নিজে পৃথিবীতে গিয়ে নিরীক্ষণ করবেন এবং দোষী দের দণ্ড দিবেন। এই কথা পৃথিবী লোকেরা জানতে পেরে তারা সতর্ক হয়ে গেলেন এবং গাই গরুদের ধোয়ান, পোছান করেন এবং গোয়াল ঘর পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন করেন এবং ঘরে ঘরে পরব শুরু করেন। তখন থেকে শুরু হয় এই পরব এবং পরে এই পরবের নাম হয় বাদনা পরব । এটি ৫ ভাগে বিভক্ত।
গোঠপূজা
অমাবস্যার দিন গোয়ালের সবচেয়ে বৃদ্ধ গরু বা মোষের শিংয়ে কচড়ার তেল মাখিয়ে গোয়ালের অন্য গরুদের শিংয়ে তেল মাখানো হয়। বিকেলবেলায় গ্রামের মোড়ে গরুগুলিকে একত্র করা হয়। মাঠের ভেতরে চালের গুঁড়ো দিয়ে ঘর কেটে ছাঁদনদড়ি ও বাঁধন দড়ির পূজা করা হয়ে থাকে। এই পূজাকে গোঠপূজা বলা হয়। পূজা শেষ হলে আলপনা এঁকে তার ভেতরে ডিম রেখে দেওয়া হয়। এরপর ঢাক, ঢোল প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র বাজানো হলে গরুগুলি ছুটোছুটি শুরু করে দেয়। কোন গরু সেই ডিম মাড়িয়ে দেয় সেই দিকে লক্ষ্য রাখা হয় এবং সেই গরুর মাথায় তেল, সিঁদুর ও ধানের শীষ দিয়ে সাজানো হয়।
কাচিজিয়ারি
অমাবস্যার সন্ধ্যাবলায় বাড়ির বিভিন্ন অংশ, তুলসীতলা, কুয়ো তলা প্রভৃতি স্থানের জানালায় কাঁঠাল বা শাল গাছের পাতায় চালের গুঁড়োর ভেতরে সলতে দিয়ে প্রদীপ জ্বালানো হয়। এই রীতিকে কাচিজিয়ারি বলা হয়ে থাকে।
জাগরণ
রাত্রে গৃহিনীরা নতুন বস্ত্র পরিধান করে কুলোয় ধান, দূর্বা, আমের পল্লব, হলুদ জল ও ধূপ ধূনা দিয়ে, ছড়া সুর করে গেয়ে গরুকে বরণ করেন। গভীর রাতে গোয়ালে ঘিয়ে প্রদীপ জ্বেলে ও উঠোনে কাঠের আগুন জ্বেলে রাখা হয়। যুবকেরা বাড়িতে বাড়িতে গরুদের জাগিয়ে রাখতে যান। এই যুবকদের ধাঁগড়িয়া বা ধাঁগড় বলা হয়। তারা অহীরা গান করে ও বাজনা বাজিয়ে বাড়িতে বাড়িতে গেলে গৃহস্থরা তাদের স্বাগত জানান। গৃহবধূরা পিটুলী গোলার সঙ্গে চালের গুঁড়ো মিশিয়ে ধাঁগড়িয়াদের সঙ্গে হোলি খেলেন।
গরয়া গোঁসাই পূজা
অমাবস্যার পরের দিন লাঙল, জোয়াল, মই প্রভৃতি চাষের যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করা হয়। গৃহকর্তা জমি থেকে এক আঁটি ধান কেটে এনে ধানের শীষ দিয়ে অলঙ্কার তৈরী করে গরু বা মোষের শিংয়ে পরিয়ে দেওয়া হয়। চাষের যন্ত্রপাতিগুলিকে পূজার পরে ঘরের ছাদে রেখে আসা হয়। এগুলিকে মাঘ মাসের প্রথম দিনে হালবহার দিনে নামিয়ে আনা হয়।
গরুখুঁটা (গরু ভীড়কা)/কাড়াখুঁটা(কাড়া ভীড়কা)।
ভাইফোঁটার দিনে গরুখুঁটা বা কাড়াখুঁটা বা বুঢ়ীবাঁধনা নামক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। এই অনুষ্ঠানে কিছু গরু বা মোষকে নির্বাচন করে তাদের গায়ে লাল ছোপ এবং কপাল ও শিংয়ে তেল ও সিঁদুর লাগিয়ে গলায় মালা, ঘণ্টা ও ঘুঙুর বেঁধে তাদের খুঁটিতে বেঁধে রাখা হয়। এরপর গরুর সামনে চামড়া রেখে চারদিক থেকে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গরুগুলিকে উত্তেজিত করলে সেগুলি চামড়াগুলিকে গুতো দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে এর নাম গরুখুঁটা বা কাড়াখুঁটা, এই অনুষ্ঠানে সেই সঙ্গে চলে অহীরা গান ও নাচ।
লেখকের মন্তব্য:-এই নিবন্ধটি ভগবান জগন্নাথের ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণায় লেখা হয়েছে। যদি কেউ বা কোনও সংস্থা এই নিবন্ধের কোনও বিষয়বস্তুর সাথে একমত না হন তবে তিনি বা তারা এটিকে দলিল প্রমাণ সহ মন্তব্যে উল্লেখ করতে পারেন এবং এটি সংশোধন করা হবে। ডকুমেন্টারি প্রমাণ এবং তথ্যের উৎস ছাড়া এই বিষয়ে যে কোনও মন্তব্যকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং অসাধু বলে গণ্য করা হবে । 🙏
সবাই ভালো থাকুন ,সুস্থ থাকুন। সমগ্র মানব জাতি ও জীব জন্তুর কল্যাণ হোক। শান্তির জয় হোক,সত্যের জয় হোক,মানবতার জয় হোক ,সনাতন ধর্মের জয় হোক। 🙏হে প্রভু আমাকে শুধু জ্ঞান দাও ,ভক্তি দাও আর শক্তি দাও🙏
লেখক পরিচিতি:-প্রবীর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উৎকল ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।প্রবীরের বইগুলি Amazon.com. flipkart.com, abebooks.com এর মাধ্যমে বিক্রি হয়।গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিন থেকে সার্চ করে এখনো পর্যন্ত ১২ লাখের বেশি লোক প্রবীরের লেখা আর্টিকেল গুলি পড়েছেন।