মানুষ স্বপ্ন কেন দেখে? স্বপ্ন কি সত্যি হয়? স্বপ্ন নিয়ে প্রশ্ন ও তার উত্তর।
স্বপ্ন হল কতগুলো ধারাবাহিক ছবি ও আবেগের সমষ্টি যা ঘুমের সময় মানুষের মনের মধ্যে আসে। এগুলো কল্পনাও হতে পারে, অবচেতন মনের কথা ও হতে পারে, বা অন্য কিছুও হতে পারে।
গ্রিক এবং রোমান যুগে মানুষ বিশ্বাস করতেন যে স্বপ্নগুলি এক বা একাধিক দেবতার কাছ থেকে আসা প্রত্যক্ষ বার্তা অথবা মৃত ব্যক্তিদের কাছ থেকে আসা বার্তা । মেসোপটেমিয়ার লোকদের বিশ্বাস ছিল যে আত্মা বা তার কিছু অংশ ঘুমন্ত ব্যক্তির শরীর থেকে বেরিয়ে আসে যা প্রকৃতপক্ষে ঐসব স্থান এবং ব্যক্তিদের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় যা স্বপ্নদর্শীরা তাদের ঘুমের মধ্যে দেখে ।
ব্যাবিলনীয়রা এবং আসিরিয়ানরা স্বপ্নকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছিলেন "ভাল স্বপ্ন" যা দেবতাদের দ্বারা প্রেরিত এবং "মন্দ স্বপ্ন" যা ভূতদের দ্বারা পাঠানো । প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতেন যে স্বপ্ন দেবতাদের কাছ থেকে বার্তা নিয়ে আসা শব্দগুচ্ছ । তারা মনে করতেন যে ঐশ্বরিক সান্নিধ্য লাভের সর্বোত্তম উপায় হল স্বপ্ন দেখা । তাই মিশরীয়রা দেবতাদের কাছ থেকে পরামর্শ, সান্ত্বনা, বা নিরাময় পাওয়ার আশায় বিশেষ ধরনের "স্বপ্নের বিছানা"তৈরি করতেন এবং তার উপর ঘুমাতেন ।
ভারতীয় উপমহাদেশে স্বপ্ন নিয়ে নানা মুনির নানা মত কেউ কেউ বলেছেন, স্বপ্ন হল মনের ভিতরের নিছক ইচ্ছার অভিব্যক্তি মাত্র কিন্তু কেউ কেউ বলেছেন, যে স্বপ্ন নিছক ইচ্ছার অভিব্যক্তি নয় ,এগুলি সত্য ও অর্ধ সত্য ও হতে পারে।
হিন্দু ধর্মের অনেক পুস্তকে বলা হয়েছে , আত্মা যখন বিশ্রাম করে তখন সে মনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে তখন মানুষ ,অবাস্তব ,অতিরঞ্জিত স্বপ্ন দেখে ,কিন্তু যখন আত্মা কম জাগ্রত/অর্ধ জাগ্রত অবস্থায় থাকে তখন মানুষ বর্তমান ও পূর্বজন্মের অর্ধ সত্য স্বপ্ন দেখে। আত্মা যখন জাগ্রত থাকে সেই অবস্থায় দেখা স্বপ্ন অনেকখানি সত্য হয়।
স্বপ্ন নিয়ে বিজ্ঞানীদের দেওয়া থিওরি(তত্ত্ব)।
1.মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব(Psychoanalytic theory)। এই তত্ত্বের মতে স্বপ্নগুলি অচেতন ইচ্ছা, অপূর্ণ ইচ্ছা এবং ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের প্রতিনিধিত্ব করে বলে বিশ্বাস করা হয়। স্বপ্নগুলি আমাদেরকে একটি অবাস্তব পরিবেশের সুরক্ষায় অচেতন আকাঙ্ক্ষাগুলি সম্পাদন করার একটি উপায় দেয়, কারণ বাস্তবে সেগুলি সম্পাদন করা অসম্ভব ও অগ্রহণযোগ্য ।
2.সক্রিয়করণ-সংশ্লেষণ তত্ত্ব(Activation-synthesis theory)। এই তত্ত্বের মতে, স্বপ্ন হল শরীর থেকে মস্তিষ্কের মজ্জায় বিশেষ ভাবে পাঠানো- সেরিব্রাল কর্টেক্স প্রসেসিং নার্ভ ইম্পলস যেটি একটি অর্থবহ সঙ্কেত /সংবাদ। Dream is the cerebral cortex processing nerve impulses being sent from the body to the brain stem into something that makes sense.
3.ক্রমাগত সক্রিয়করণ তত্ত্ব (Continual activation theory)। এই তত্ত্বের মতে, স্বপ্ন দেখা মস্তিষ্কের সক্রিয়তা এবং সংশ্লেষণের ফলাফল।
A).1993 সালে মনোবিজ্ঞানী (Joe Griffin) জিও গ্রিফিন তাঁর Expectation fulfilment theory (স্বপ্ন দেখার প্রত্যাশা পূরণ তত্ত্ব)তে বলেন যে *REM ঘুমের সময় মানুষের মন ও মস্তিষ্ক থেকে অ-নিঃসৃত মানসিক উত্তেজনা (প্রত্যাশা) যা পূর্ববর্তী সময়ে প্রকাশ করা হয়নি,তা ডিসচার্জ করা স্বপ্নের প্রধান কাজ। তাঁর তত্ত্ব অনুসারে অত্যাধিক মাত্রায় অনিচ্ছাকৃত চিন্তা ,ভাবনা ও কল্পনা REM ঘুমের সময় মানুষের অটোমেটিক নার্ভস সিস্টেমকে(স্বায়ত্তশাসিত স্নায়ুতন্ত্র )জাগিয়ে তুলে যার কারনে মানুষ স্বপ্ন দেখে। *REM=Rapid Eye Movement (ঘুমের সময়)।
B).সিগমুন্ড ফ্রয়েড বলেন, স্বপ্ন মূলত মানুষের গোপন আকাঙ্ক্ষা এবং আবেগের প্রকাশ।
স্বপ্ন নিয়ে প্রশ্ন ও উত্তর।
1.স্বপ্ন কি ?
স্বপ্ন হল মানুষের ঘুমন্ত অবস্থায় অবচেতনভাবে অনুভব করা ঘটনা।
2.ভোরের স্বপ্ন কি সত্যি হয়?
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। ভোরবেলায় কোনও শুভ স্বপ্ন দেখলে মানুষের আনন্দ হয় ও নিশ্চিন্ত মনে দিন কাটে , কিন্তু ভোরবেলায় কোনও ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখলে এবং তা যদি অশুভ হয়, তা হলে দুঃখে ও দুশ্চিন্তায় মানুষের দিন কাটে।
3.ভয়ানক স্বপ্ন দেখার কারণ কি?
মানসিক চাপ
4.মানুষ কতক্ষণ স্বপ্ন দেখে?
গড়ে একটি স্বপ্নের স্থায়িত্ব হয় ১০ থেকে ১৫ মিনিট।
তবে সবচেয়ে লম্বা স্বপ্নের স্থায়িত্ব হয় ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট।
5.স্বপ্ন দেখার সময় মানুষের কি হয়?
মানুষের চোখ বন্ধ থাকে কিন্তু বন্ধ চোখের মধ্যে Rapid Eye Movement (REM)হয়। এই সময় হার্টরেট বেড়ে যায়, রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়।
6.কারা বেশি স্বপ্ন দেখেন?
১.প্রেগন্যান্ট মায়েরা বেশি স্বপ্ন দেখেন ।
২.অবসাদ থাকলে, দুশ্চিন্তা হলে,মানুষ বেশি স্বপ্ন দেখে।
৩.রাতের বেলায় তৈলাক্ত খাবার খেলে ঘুম ভালো হয় না এতে মানুষ বেশি স্বপ্ন দেখে।
৪.মনের আশা ও আকাঙ্খা বেশি হলে, মানুষ বেশি স্বপ্ন দেখে।
৫.মনের ভাবনা ,চিন্তা বেশি হলে মানুষ বেশি স্বপ্ন দেখে।
7.স্বপ্ন দেখা কি ভালো?
হাঁ ,কারণ স্বপ্নের মাধ্যমে আমাদের স্মৃতি শক্তি মজবুত হয়। স্বপ্নের মাধ্যমে আমাদের আবেগ সঠিক পথে চালিত হয়। স্বপ্নের দ্বারা বহু সৃজনশীলতার সৃষ্টি হয়। সারাদিনে মস্তিষ্ক অনেক তথ্য সংগ্রহ করে কিন্তু সেই তথ্যকে ছোট করতে স্বপ্ন দেখার প্রয়োজন হয় ।
8.মানুষ কখন বেশি স্বপ্ন দেখে ?
মানুষ সাধারণত ঘুমের শেষের দিকে বেশি স্বপ্ন দেখে।
9.মানুষ স্বপ্ন কেন দেখে?
মানুষ যখন গভীর নিদ্রার পর কম জাগ্রত অবস্থায় থাকে তখন সে তার মস্তিস্ক ও মনের উপর পূর্ন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে যার ফলে তার মনে কোনো বিষয় বস্তু অনিয়ন্ত্রিত ভাবে স্বপ্নের মাধ্যমে সামনে আসে। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত স্নায়ুরোগ বিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, স্বপ্ন মূলত মানুষের গোপন আকাঙ্ক্ষা এবং আবেগের প্রকাশ। মানুষের মনে অনেক অবদমিত/ সুপ্ত ইচ্ছা থাকে। স্বাভাবিক সময়ে মানুষরা এর টের পায় না। মানুষ শোবার সময় এই অবদমিত / সুপ্ত ইচ্ছা গুলি স্বপ্নের মাধ্যমে সামনে আসে। এছাড়া কিছু বিজ্ঞানীদের মতে যদি ঘুমের সময় মানুষের মস্তিষ্কে কিছু সংকেত পৌঁছে যায় তাহলে মানুষ স্বপ্ন দেখে ।
10.মানুষ কোন সময়ে বেশি স্বপ্ন দেখে ?
মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে যদি সেই সময় কোন কারণে যেমন জল পান করিবার ইচ্ছা,প্রসাব যাবার ইচ্ছা ইত্যাদি হয় তখন মানুষ কে জাগাবার জন্য মানুষের মস্তিষ্কে কিছু সংকেত পৌঁছে যায় ,সেই সময় ঘুম সামান্য হালকা হয় এবং তখন বেশির ভাগ মানুষ স্বপ্ন দেখে ।
11.একই স্বপ্ন বারবার দেখার কারণ কি ?
গবেষকরা জানিয়েছিলেন, কোনও বিষয় নিয়ে চরম আতঙ্ক ,ইচ্ছা /আসক্তি একই স্বপ্ন বারবার দেখাতে পারে। সাধারণত যাঁরা মানসিক ভাবে দুর্বল, তাঁরাই এক স্বপ্ন বারবার দেখেন। তবে গবেষকরা এমনটিও বলেছেন, যে কারণে কেউ আতঙ্কে আছেন অথবা ভয় টি পাচ্ছেন, সেই কারণটি আর না থাকলে ভয়ের স্বপ্নটিও আর ফিরে আসে না। অনেকেই বলেন বারবার স্বপ্ন দেখার অর্থ স্বপ্নের মাধ্যমে কোনো একটা বার্তা আপনাকে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে,আর আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে সেই বার্তাটা কি। যখন আপনি এতে সফল হবেন, তখনই হয়তো একই স্বপ্ন বারবার আসা বন্ধ হবে।
12. স্বপ্ন কি সত্যি হয়?
শ্রী মদ ভাগবত মহাপুরান (চতুর্থ স্কন্ধ ২৯তম অধ্যায় )এর মতে কলি যুগের নীতি ও নিয়ম অনুসারে স্বপ্ন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সত্যি হয় না, তবে অনেক স্বপ্ন সত্যি হয়,কখনো কখনো স্বপ্ন বার্তাবহ ও হয়, যেমন যে বিষয় নিয়ে কোন পূর্ব জ্ঞান নেই সেই বিষয় নিয়ে স্বপ্ন দেখলে অনেক সময় সেই স্বপ্ন সত্যি ও বার্তাবহ হয়।
ভালো স্বপ্ন দেখার পর মানুষ ও চেতনে বা অবচেতনে ভাবতে ভালোবাসে যে, স্বপ্ন হয়ত সত্যি হবে কিন্তু সেই স্বপ্ন সত্যি হতে পারে, না হলে মিথ্যাও হতে পারে ,তবে স্বপ্ন যাই হোক না কেন “স্বপ্নই শুধু পারে ব্যর্থতার তলানী থেকে একজন মানুষকে আবার উঠে দাঁড়ানোর সাহস যোগাতে” তাই স্বপ্ন নিয়ে থাকা ও স্বপ্ন নিয়ে উৎসাহ রাখা প্রয়োজন।
লেখকের মন্তব্য:-
এই নিবন্ধটি ভগবান জগন্নাথের ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণায় লেখা হয়েছে। যদি কেউ বা কোনও সংস্থা এই নিবন্ধের কোনও বিষয়বস্তুর সাথে একমত না হন তবে তিনি বা তারা এটিকে দলিল প্রমাণ সহ মন্তব্যে উল্লেখ করতে পারেন এবং এটি সংশোধন করা হবে। ডকুমেন্টারি প্রমাণ এবং তথ্যের উৎস ছাড়া এই বিষয়ে যে কোনও মন্তব্যকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং অসাধু বলে গণ্য করা হবে । সবাই ভালো থাকুন ,সুস্থ থাকুন। 🙏