বিলুপ্তির পথে পুরোহিত ও পৌরহিত্য' এবং সংক্ষেপে সনাতন হিন্দু ধর্মে পূজার ক্রম/নিয়ম।
পুরোহিত ও পৌরহিত্য নিয়ে জানার আগে আমাদের কতগুলি টার্ম (সংজ্ঞা ) স্পষ্ট ভাবে জানা দরকার।
1.গুরু: গু এর অর্থ অন্ধকার এবং রু এর অর্থ প্রকাশ । অর্থাৎ যিনি অন্ধকার থেকে আলোর রাস্তায় নিয়ে যান তিনি হলেন গুরু। উদাহরণ;দেব গুরু(বৃহস্পতি ), রাজগুরু ইত্যাদি।
2.আচার্য: যার বেদ এবং শাস্ত্রের জ্ঞান আছে এবং যিনি গুরুকুলে ছাত্রদের শিক্ষা প্রদান করেন তাকে আচার্য বলা হয় ।মহান আচার্য্যের উদাহরণ - কৃপাচার্য,দ্রোণাচার্য্য ।
3.পুজারি:- যিনি মন্দির বা অন্য কোন স্থানে পূজা পাঠ করেন তিনি হলেন পূজারী।পূজারীগণ পূজা, আরতি, ভগবানের মূর্তির যত্ন নেওয়া সহ মন্দিরের নিত্যকর্মসমূহ সম্পাদন করেন।
আমাদের সমাজের এই পুরোহিতরা অতি সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আমাদের হিত করে চলেছেন কারণ এঁদের ধর্মচিন্তা আলাদা কিন্তু আমাদের ধর্মচিন্তা বড়ই অদ্ভুত ও বিচিত্র। আমরা যেমন হাজার হাজার অন্যায় ,অবিচার পাপ ও ব্যভিচার করার পর, একবার গঙ্গা স্নান করেই অন্যায় ,অবিচার পাপ ও ব্যভিচার কে ধুয়ে ফেলতে চাই তেমনিই , মন্দিরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে টুক করে একটা প্রণাম করে পুন্য লাভ করতে চাই। বাড়িতে পুরোহিত ডেকে পূজা করালেই আমাদের সব কিছু যেন চরিতার্থ, সফল/সার্থক হয়ে যায়, কিন্তু যারা পূজা করেন ,অর্থাৎ সেই পুরোহিতরা কেমন জীবন যাপন করেন সে ব্যপারে আমরা কেউ আর খোঁজ খবর নিই না। যার ফলে পুরোহিত সমাজটাই আজ বিলুপ্তির পথে। যুগের নিয়মে হারিয়ে যেতে বসেছে পুরোহিত ও পৌরহিত্য
গুরু গৃহ।
আগে অনেক গুরু কুল ও গুরু গৃহ/টোল ছিল,যে গুলি বৈদিক ব্রাহ্মণদের দ্বারা চালিত হত এবং সেখানে সঠিক অর্থে সংস্কৃত মন্ত্রের উচ্চারণ শেখানো হত। আজ বৈদিক ব্রাহ্মণদের যে সন্তান সন্ততি আছেন , তাঁদের অনেকেই জানেন না বৈদিক ব্রাহ্মণ শব্দের অর্থ কি ? মন্ত্র উচ্চারণ,তার সঠিক অর্থ অনুধাবন, বৈদিক জ্ঞান তো অনেক দূরের ব্যাপার। সত্যি কথা বলতে কি,বৈদিক ব্রাহ্মণ আজ প্রায় লুপ্ত ।
নতুন জেনারেশন ও পূজা।
নতুন জেনারেশনের বাড়িতে এখন পূজাই বা কোথায় ? সকাল দশটা থেকে রাত দশটার জীবনে
কোথায় পূজা ? কোথায় ব্রাহ্মণ ? আগে, পুণ্য করার জন্যে ব্রাহ্মণ ভোজন করাতে হত। আগে লক্ষ্মী পূজা হোক কিংবা সরস্বতী পূজা বা নারায়ণ পূজা , সব অনুষ্ঠানের যে সকল বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করা হবে তার যথার্থ মানে বুঝিয়ে পূজা সম্পন্ন করাই ছিল কুলপুরহিতের মূল কাজ। নামকরণ থেকে নান্নিমুখ,বিবাহ থেকে বউ আনা (নতুন বউ কে বাড়ি আনা), গৃহ নির্মাণ থেকে গৃহপ্রবেশ ইত্যাদি ও পারলৌকিক কাজ যেমন শ্রাদ্ধ্য, সপিন্ডকরণ, বাত্সরিক পিন্ড দান ইত্যাদি সবকিছুতেই কুলপুরোহিতদের ডাক পড়ত,এক কথায় পুরোহিত ছিলেন পরিবারের সঙ্গী। আজকাল গৃহস্থ (বাড়িতে বাড়িতে) পূজার পরিবর্তে সামূহিক পূজার প্রচলন বাড়ছে এবং সেখানে পূজার খরচ কম আমোদ প্রমোদের খরচই বেশি,আগে যেখানে গৃহস্থদের বাড়িতে ১০০ জন পুরোহিত পৌরহিত্য করতেন এখন সামূহিক পূজাতে সেখানে ১জন পুরোহিত পৌরহিত্য করছেন,যার পরিনাম স্বরূপ হিন্দু সমাজের ব্রাহ্মণরা হত দরিদ্র হচ্ছেন । আজকের হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণরা যে এত হত দরিদ্র হবেন তা আগে চিন্তা করাও যেত না।
এযুগে হিন্দুদের অধিকাংশ পুরোহিত ব্রাহ্মণ দরিদ্র হলেও আমাদের চারপাশের অন্য তিনটি ধর্মানুসারীদের (মুসলিম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ) ধর্মগুরু/পুরোহিত এত হত দরিদ্র খুঁজে পাওয়া যাবে না।
“হিন্দু পরিবারে জন্ম থেকে মৃত্যুতে অপরিহার্য অবদান পুরোহিতদের কিন্তু বর্তমান সময়ে হিন্দু ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের অবস্থা অন্যান্য (ইসলাম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ) ধর্মের ধর্মগুরুদের চাইতে তুলনামূলক অনেক খারাপ। অন্যান্য ধর্মের প্রতিনিধিদের জন্যে সরকারী তরফে কত রকম সুযোগ সুবিধা কিন্তু হিন্দুদের জন্যে কোথায় এসব? ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ইমামেরা যতটা প্রভাবশালী, তাঁরা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে যতটা সংগঠিত, সেই নিরিখে সনাতন হিন্দু ধর্মের পুরোহিতদের কোনো তুলনাই চলে না ৷ বাঙালি থেকে বিহারি, কাশ্মীরি থেকে কান্নাড়ি ,তামিল থেকে তেলুগু ভারতের সর্বত্র সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে পুরোহিতদের সেই প্রভাব নেই ৷ এছাড়া মুখে ধর্ম নিরপেক্ষ দেখালেও সংখ্যালঘু দের নাম করে হিন্দু পুরোহিতদের এবং ধর্মগুরুদের বঞ্চিত করাই প্রধান কাজ হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক দলগুলির।
পুরোহিতদের ভাতা।
ভারতবর্ষের বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকার রেজিস্টার্ড মন্দিরের পুরোহিতদের প্রত্যেক মাসে সামান্য কিছু মাসোহারা দিচ্ছেন তাহা সত্যি ই প্রসংশনীয়। যদিও এটি পোষা হাতিকে মাহুত(হস্তী চালক) কে দিয়ে ধান খাওয়ানোর মতো। আমাদের পুরোহিতরা অল্পতেই সন্তুষ্ট, তাঁরা,সহজ ,সরল তাই তাদের অনেকেই বলছেন ,এই সামান্য কিছু মাসোহারা পেয়ে তাঁরা আনন্দিত , ''নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো ''।
পুরোহিতরা হিন্দু সম্প্রদায়ের যে কোনো ধর্মীয় উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ ৷ শুধু সর্বজনীন উৎসব নয়, গৃহস্থের বাড়িতে পূজা , শ্রাদ্ধানুষ্ঠান-সহ বিভিন্ন ধর্মীয় কাজকর্মে ডাক পড়ে পুরোহিতদের ৷ অতি সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে পুরোহিতরা যে কাজ করেন, সেটিকে জীবিকার একটি অসংগঠিত ক্ষেত্র বলা চলে ৷ তাই অনেকেই আজ বলছেন, পুরোহিতদের আর্থিক নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের জন্য উপযুক্ত ভাতার ব্যবস্থা করার মধ্যে অন্যায্য কিছু নেই ।
পুরোহিতদের অসম্মান/অপমান।
আমরা আজকাল বিবাহ ,বার্থডে সেলিব্রেশন ও কিছু পূজা পার্বন কে মধুশালা তে রূপান্তরিত করেছি আর সেই মধুশালাতে বন্ধু ,বান্ধবীদের ,সামলাতেই আমরা ব্যস্ত থাকি। পুরোহিত মহাশয় অনাহূতের মতো এদিক ওদিক ঘুরতে থাকেন,মাঝে ,মাঝে আমরা বলতে থাকি শর্টকাট করুন,তাড়াতাড়ি করুন ,ফালতু জিনিস করার দরকার নেই। এই গুলি কি তাঁকে অসম্মান করা নয় । এছাড়া আমরা সাধারণ মানুষরা লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে পূজা করতে পারি, অথচ পুরোহিত মশাইয়ের ধুতি কিনতে গেলে আমাদের পকেটে টান পড়ে। আমরা পূজার জন্য শাড়ি-গামছা কিনতে গিয়ে দোকানে বলি "পূজার,ধুতি /শাড়ি, গামছা চাই"(তার মানে সব থেকে কম দামী টা দিন )। আমরা পূজার জন্য ফল কিনতে গিয়ে দুই ধরনের ফল কিনি ,ঠাকুরের জন্য আলাদা, পুরোহিত মহাশয়ের জন্য আলাদা। আমরা আলোকসজ্জা,পুজো প্যান্ডেল এর বায়না করার সময় বলি ঐ ক্লাবের থেকে ভালো আলোকসজ্জা চাই, ঐ পাড়ার থেকে ভালো প্যান্ডেল, লাইট এন্ড সাউন্ড সিস্টেম চাই,বেশি টাকা লাগলে লাগুক। অথচ পুরোহিত মহাশয় কে সামান্য পয়সা খরচ করে একটা ধুতি ,গামছা দিতে গেলেই কষ্ট ৷ আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি পূজা করার সময় পুরোহিত মশাই কেন ধুতির উপর গামছা পরেন। কারন আমরা পুরোহিত মশাইয়ের জন্য যে ধুতি (কমদামি) কিনে আনি সেটা দিয়ে এপার ওপার দেখা যায় এবং সামান্য টান পড়লেই কাপড় টি ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এটা কি তাকে অবজ্ঞা ,অপমান বা ছোট করা নয় ।
পুরোহিত সংকট।
আমাদের প্রতিনিয়ত অসম্মান/অপমানের কথা ভেবে একজন পুরোহিত তার সন্তানকে পুরোহিত না বানিয়ে চাকুরী ,ব্যবসা অথবা অন্য কাজে লাগিয়ে দিচ্ছেন। তাই আজকাল পূজা পার্বণে পুরোহিত সংকট দেখা দিয়েছে। তাই অনুরোধ পুরোহিত মশাই কে সম্মান দিন ,তার খেয়াল রাখুন। তবেই পূজা, পার্বন বাঁচবে আর পূজা পার্বন বাঁচলেই ,ব্যক্তি জীবনে ও সমাজে শান্তি ,সৌহার্দ্য বিরাজ করবে।
ভগবানকে নিমন্ত্রন ।
আচমনি/আচমন-পূজোর আগে জল দ্বারা দেহ -শুদ্ধি।
1.ভগবানের ধ্যান ।
2.ভগবানকে আবাহন।
3.ভগবানকে আসনে বসাতে হবে।
4.পাদ্য ( ভগবানকে পা ধোয়ানোর ও তার পরে পা মোছাতে হবে। )
5.অর্ঘ্য(ভগবানকে বরণের জন্য মালা চন্দন ইত্যাদির উপচার)।
6.স্নান জল জল দিয়ে স্নান করাতে হবে।
7.স্নান-ভগবানকে দুধ, ঘি, শর্করা, মধু, দুধ, উষ্ণ জল দিয়ে স্নান করাতে হবে।
8.পঞ্চামৃত স্নান= দুগ্ধ, দধি, ঘৃত (ঘী), মধু, কে এক সাথে মিলিয়ে স্নান করাতে হবে।
9.শুদ্ধোদকস্নান- শুদ্ধ জল দ্বারা স্নান করাতে হবে।
"পয়োদধি ঘৃতং চৈব মধু চ শর্করায়ুতং ।
পঞ্চামৃতং ময়ানীতং স্নানার্থং প্রতিগৃহ্যতাম্ ॥"
10.পোশাক-ভগবানকে পোশাক পরাতে হবে। অথবা তার সামনে তাঁর পরার জন্য পোশাক রাখতে হবে।
11.চন্দন-ভগবানকে চন্দন লাগাতে হবে।
12.যজ্ঞোপবীত (পৈতা)-ভগবানকে পৈতা পরাতে হবে।
13.পুষ্প,দূর্বা ঘাস ভগবান বিষ্ণুকে অর্পণ করতে হবে।
তুলসী/শমীপত্র ভগবান গণেশ কে অর্পণ করতে হবে।
সাদা,অখন্ডিত, নিঁখুত আতপ চাল(অক্ষত )ভগবান শিব কে অর্পণ করতে হবে।
দেবীকে লাল অখন্ডিত, নিঁখুত আতপ চাল কে অর্পণ করতে হবে।
অন্যেকে হলুদ অখন্ডিত, নিঁখুত আতপ চাল অর্পণ করতে হবে।
14.সুগন্ধি পদার্থ- ইত্র ,ধূপ,দীপ,ইত্যাদি দিয়ে আরতি।
15.নৈবেদ্য।
16.পান /সুপারি অর্পণ করতে হবে।
17.পুষ্পাঞ্জলি ।
অনেক সময় আমরা যে ভগবানের পূজা করছি ,তাঁর আরতি না জানার জন্য আমরা তাঁর আরতি করতে পারিনি , সেই পরিস্থিতিতে, ভগবান নারায়ণের আরতি করুন,কারণ ইনিই পরমাত্মা ,পরমব্রহ্ম , আমরা যে কোন ভগবানের পূজা করি না কেন , সমস্ত পূজা এঁর কাছে যায়। শুনুন পণ্ডিত শ্রদ্ধা রাম (শর্মা) ফিল্লউরির লেখা ভারতের সর্বাধিক জনপ্রিয় ওঁম জয় জগদীশ হরে আরতি টি।
বেদাঙ্গের নিয়ম অনুসারে ং উচ্চারণ হবে অম কিন্তু অম এর টান টি হবে ছোট ।
লেখকের মন্তব্য:-এই নিবন্ধটি ভগবান জগন্নাথের ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণায় লেখা হয়েছে। যদি কেউ বা কোনও সংস্থা এই নিবন্ধের কোনও বিষয়বস্তুর সাথে একমত না হন তবে তিনি বা তারা এটিকে দলিল প্রমাণ সহ মন্তব্যে উল্লেখ করতে পারেন এবং এটি সংশোধন করা হবে। ডকুমেন্টারি প্রমাণ এবং তথ্যের উৎস ছাড়া এই বিষয়ে যে কোনও মন্তব্যকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং অসাধু বলে গণ্য করা হবে
সবাই ভালো থাকুন ,সুস্থ থাকুন। সমগ্র মানব জাতি ও জীব জন্তুর কল্যাণ হোক। শান্তির জয় হোক,সত্যের জয় হোক,মানবতার জয় হোক ,সনাতন ধর্মের জয় হোক। 🙏
লেখক পরিচিতি:-প্রবীর মহান্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উৎকল ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।প্রবীরের বইগুলি Amazon.com. flipkart.com, abebooks.com এর মাধ্যমে বিক্রি হয়।গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিন থেকে সার্চ করে এখনো পর্যন্ত ১২ লাখের বেশি লোক প্রবীরের লেখা আর্টিকেল গুলি পড়েছেন।
1.কৃতজ্ঞতা স্বীকার-(AjBanglaTV-Daily hunt).