ভারতবর্ষ নামটির উৎপত্তি এবং প্রাচীন ভারতবর্ষের দুই প্রধান রাজবংশ - সূর্য বংশ ও চন্দ্র বংশের ইতিহাস।

সূর্য বংশ ও চন্দ্র বংশ

পৌরাণিক ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি প্রাচীন কালে  দুটি প্রধান শক্তিশালী ও ধনশালী রাজবংশ ভারতবর্ষে রাজত্ব করেছিলেন ।এই  রাজ বংশ দুটির নাম হল সূর্য বংশ এবং চন্দ্র বংশ। রামায়ণ মহাভারত এবং পুরাণ গুলিতে এই বংশ দুটির শৌর্য, পরাক্রম, এবং ধর্ম পালন এর কথা  বর্ণনা করা   হয়েছে। বিভিন্ন পুরাণে এই বংশ দুটির পরম্পরা দেওয়া আছে। পুরাণ গুলিতে একই বংশের বর্ণনায় কিছুটা তারতম্য দেখা যায় । এই বিভ্রান্তির প্রধান  কারণ হল এর প্রাচীনত্ব। তবে যারা ইতিহাসের মূল নায়ক তাদের নিয়ে কোন দ্বিমত নেই যেমন- দশরথের পুত্র রাম, বাসুদেব (বসুদেব) পুত্র কৃষ্ণ  ইত্যাদি । যাই হোক প্রথমে  সূর্য বংশের কথাতে যাই।

সূর্য বংশ:-
 প্রজাপতি কশ্যপের পৌত্র বিবস্বান (সূর্য) থেকে সূর্য বংশের উৎপত্তি। এই সূর্য বংশের প্রথম রাজা  হলেন ইক্ষ্বাকু। তিনি ছিলেন বৈবস্বত মনুর পুত্র। তিনি প্রথম অযোধ্যার সিংহাসনে বসেন। এই রাজ বংশ থেকে অনেক জগৎ বিখ্যাত এবং দিগ্বিজয়ী রাজা আমাদের দেশের শাসক ছিলেন । যেমন রাজা যুবনাশ্বের পুত্র– রাজা মান্ধাতা ।  বিষ্ণুপুরাণে মান্ধাতার কাহিনি পাওয়া যায় ।
ভগবান শ্রী রামচন্দ্র।



এই বংশের আরেক বিখ্যাত রাজা হলেন রাজা হরিশ্চন্দ্র, যার কথা আমরা সকলেই জানি। সূর্য বংশেই  বিখ্যাত রাজা সাগর (সগর) জন্ম গ্রহন করেন।এই  রাজ বংশের ভগীরথ স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে  মর্তে এনেছিলেন । এই বংশের আরেক বিখ্যাত রাজা হলেন রঘু, যিনি রঘু বংশের প্রতিষ্ঠাতা। এই রঘু বংশে ভগবান শ্রী রামচন্দ্র জন্ম গ্রহণ করেন। শ্রী রামচন্দ্রের জীবনী নিয়ে লেখা রামায়ণ  জগৎ বিখ্যাত।

 অপরদিকে সূর্য বংশীয় মহারাজ নিমির সপ্তবিংশতি (২৭) পুরুষ ,রাজা জনক, যিনি শক্তিরূপা লক্ষ্মীর অবতার এবং আদর্শ স্ত্রী তথা আদর্শ নারী ,উৎসর্গীকরণ, আত্মবিসর্জন, সাহসিকতা এবং বিশুদ্ধতার প্রতীক, সীতার বাবা ছিলেন।
 এই হল অতি সংক্ষেপে সূর্য বংশ ও তার বিখ্যাত রাজন্যবর্গের বর্ণনা । যাই হোক এবার  চন্দ্রবংশের কথাতে যাই।

চন্দ্রবংশ:-
চন্দ্র থেকে  এই বংশের সৃষ্টি হয়েছে  বলে এর  নাম  চন্দ্রবংশ। চন্দ্রবংশ যাদব ও পৌরব নামে দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম বংশ যদু থেকে এবং দ্বিতীয় বংশ পুরু থেকে সৃষ্টি হয়েছে । কৃষ্ণ যদুবংশোদ্ভূত এবং কুরুপান্ডব পুরুবংশোদ্ভূত।
চন্দ্র ব্রহ্মার মানস পুত্র অত্রিমুনির সন্তান। চন্দ্র জন্মের পরই ত্রিচক্র রথে চড়ে পৃথিবী পরিক্রমা ও আলোকদান করতে থাকেন। তিনি দক্ষপ্রজাপতির কন্যা ভরণী, কৃত্তিকা, আর্দ্রা, অশ্লেষা, মঘা, উত্তরফাল্গুনী, বিশাখা, উত্তরাষাঢা, রোহিনী নামে সাতাশজন কন্যাকে বিবাহ করেন। তাদের মধ্যে চন্দ্র রোহিনীকে সর্বাপেক্ষা বেশী ভালবাসতেন। কিন্তু তার ফলে অন্যান্য স্ত্রীগণ চন্দ্রের বিরুদ্ধে দক্ষ প্রজাপতির  কাছে অভিযোগ করেন।  দক্ষপ্রজাপতি জামাতাকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে অভিশাপ দেন যে, চন্দ্র পুত্রকন্যাহীন হবেন  এবং যক্ষ্মারোগগ্রস্ত হবেন । দক্ষপ্রজাপতির কন্যারা ভীত হয়ে তার অভিশাপ প্রত্যাহারের জন্য প্রার্থনা করলে দক্ষপ্রজাপতি বলেন  যে - যক্ষ্মারোগে চন্দ্র ,মাসের মধ্যে এক পক্ষে ক্ষয়প্রাপ্ত হবেন ও  অন্য পক্ষে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবেন। এ দুই পক্ষই  এখন কৃষ্ণপক্ষ ও শুক্লপক্ষ নামে প্রসিদ্ধ  (কালিকাপুরান)। চন্দ্রের মাতার নাম ইলা (বৈবস্বত মনুর কন্যা) ,পুত্রের নাম বুধ।



  বুধ
 ব্রহ্মা বুধকে গ্রহাধিপত্যে স্থাপন করেন। বুধের পুত্রের নাম পুরূরবা। একবার রাজা পুরূরবা ইন্দ্রের রাজসভায় আমন্ত্রিত হলেন। ইন্দ্র , রাজা পুরূরবার জন্যে নৃত্য-গীতের আয়োজন করলেন। সেখানে নৃত্য পরিবেশন করেন উর্বশী নামের এক অপ্সরা। উর্বশীকে দেখে রাজা পুরূরবা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকলেন, কী অপরূপ তার রূপের মাধুর্য! আর কী চমৎকার তার নৃত্যগীত! পুরূরবার মুগ্ধ নয়নে নয়ন পড়তেই চমকে যান  উর্বশী।  রাজা পুরূরবার সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হলে উর্বশী’র নৃত্যে তাল ভঙ্গ হয়। এতে ইন্দ্র উর্বশীর প্রতি ক্রোধান্বিত হয়ে মর্ত্যলোকে জন্ম গ্রহণের অভিশাপ দেন। উর্বশী মর্ত্যলোকে এসে পুরূরবার স্ত্রী হন। পুরূরবা ও উর্বশীর সাত পুত্র। আয়ু, অমাবসু, বিশ্বায়ু, স্রুতায়ু, দৃঢ়ায়ু, বলায়ু ও শতায়ু। আয়ু চন্দ্রবংশের রাজা হন। তিনি রাজকন্যা প্রভাকে বিবাহ করেন। তাদের নহুষসহ পাঁচপুত্র হয়। নহুষ  চন্দ্রবংশের রাজা হন।
 নহুষের ছয় পুত্রের যযাতি জ্যৈষ্ঠ পুত্র। পিতার মৃত্যুর পর যযাতি চন্দ্রবংশের রাজা হন। তার দুই স্ত্রী  দেবযানী ও শর্মিষ্ঠা। দেবযানী দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের কন্যা আর শর্মিষ্ঠা দৈত্যরাজ বিষপর্বার কন্যা। দেবযানীর গর্ভে যদু ও তুর্বসু নামে দুই পুত্রের জন্ম হয় এবং শর্মিষ্ঠার গর্ভে দ্রুহ্য, অনু  ও পুরু,  নামে পুত্রের জন্ম হয়। যযাতির মৃত্যুর পর পুরু ও যদু  চন্দ্রবংশের রাজা হন।
যদু ও তার ভ্রাতা পুরু  চন্দ্রবংশের দুই শাখার (যাদব ও পৌরব) প্রতিষ্ঠাতা। প্রথম বংশ যদু থেকে এবং দ্বিতীয় বংশ পুরু থেকে সৃষ্টি হয়েছে । কৃষ্ণ যদুবংশোদ্ভূত এবং কুরুপান্ডব পুরুবংশোদ্ভূত।

ভারতবর্ষ নামটির উৎপত্তি। 
 পুরাতন লিপি থেকে জানা যায় যে ভারতবর্ষ নামটির পরিচিতির পূর্বে ভারত, জম্বুদ্বীপ নামেই পরিচিত ছিল। সূর্যসিধান্তের লেখায় পাওয়া জম্বুদ্বীপ। সনাতন সৃষ্টিতত্ব (মানে হিন্দু বৌদ্ধ কিংবা জৈন) অনুযায়ী জম্বুদ্বীপ মানে হল “সাধারন মানুষের বাসস্থান”।  
 ভারতবর্ষ। 
পুরুর তিন পুত্র-প্রবীর, ঈশ্বর ও রৌদ্রাশ্ব।  পুরু বংশধরদের পৌরব বলা হয়।  এই পৌরব বংশ হতে কৌরব ও পান্ডব বংশের সৃষ্টি হয় । 
 পুরু পুত্র প্রবীরের হাতে  রাজ্যভার অর্পণ করেন। প্রবীর শূরসেনী নামে কন্যাকে বিবাহ করেন। এর পর  তার পুত্র মনস্যু চন্দ্রবংশের রাজা হন। রাজা মনস্যুর তিন পুত্র। তাদের মধ্যে রাজা হন সংহনন। এর পর  সংহনন এর দশ পুত্র। রাজা হলেন মতিনা। মতিনার চার পুত্র। রাজা হলেন তংসু। তংসুর চার পুত্র রাজা হলেন ঈনিল। ঈনিল তার মহাতেজা পঞ্চ পুত্র। রাজা হন দুষ্মন্ত। দুষ্মন্তের পুত্রের নাম রাজা ভরত। প্রচলিত বিশ্বাস ও  মহাভারত অনুসারে অনুযায়ী, ভরত সমগ্র ভারত জয় করেছিলেন। এই জন্য তার বিজিত অঞ্চল ভারতবর্ষ নামে পরিচিত হয়।
    

এ হচ্ছে পুরুবংশের বিবরণ। এখানে বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য যে, ত্রেতাযুগে যেমন সূর্যবংশের পরিচয় রামায়ণে লিপিবদ্ধ আছে তেমনি দ্বাপরযুগের চন্দ্রবংশের বংশ পরিচয়ও মহাভারতে লিপিবদ্ধ আছে। এ দুই গ্রন্থ ব্যতীত অন্যান্য গ্রন্থ যেমন-  ভাগবত, অগ্নিপুরাণ, গরুড়পুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ ও হরিবংশে সূর্যবংশ ও চন্দ্রবংশের বংশ পরম্পরা বিবৃত আছে। তবে এসব গ্রন্থে সূর্যবংশে ও চন্দ্রবংশে বংশ পরম্পরায় অনেক গরমিল পরিলক্ষিত হয়। লক্ষ লক্ষ বছর পূর্বে এ সকল বংশে হাজার হাজার মানুষ জন্মগ্রহণ করেছিলেন  । তাদের নাম বংশানুক্রমে লিপিবদ্ধ করা অত্যন্ত দূষ্কর ব্যাপার। যার ফলে পুরাণসমূহের মধ্যে এ রকম মতভেদ দৃষ্ট হয়। তবে এগুলি লিপিকারদের ভুলের কারণে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী।🙏

লেখকের মন্তব্য:-এই নিবন্ধটি ভগবান জগন্নাথের ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণায় লেখা হয়েছে। যদি কেউ বা কোনও সংস্থা এই নিবন্ধের কোনও বিষয়বস্তুর সাথে একমত না হন  তবে তিনি বা তারা এটিকে দলিল প্রমাণ সহ মন্তব্যে উল্লেখ করতে পারেন এবং এটি সংশোধন করা হবে। ডকুমেন্টারি প্রমাণ এবং তথ্যের উৎস  ছাড়া এই বিষয়ে যে কোনও মন্তব্যকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং  অসাধু বলে গণ্য করা হবে 

সবাই ভালো থাকুন ,সুস্থ থাকুন। সমগ্র মানব জাতি ও জীব জন্তুর  কল্যাণ হোক। শান্তির জয় হোক,সত্যের জয় হোক,মানবতার জয় হোক ,সনাতন ধর্মের জয়  হোক। 🙏হে প্রভু আমাকে শুধু জ্ঞান দাও , ভক্তি দাও আর শক্তি দাও🙏
























আমি এই আর্টিকেল টি আমার এক মাত্র 
ছেলে ৺  >আকাশের< জন্য উৎসর্গ করিলাম।
Appreciation Mail of  Jeremie Lumbroso
lecturer Princeton University. USA



 লেখক পরিচিতি:- প্রবীর কুমার মহান্তী  ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের  উৎকল ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।  প্রবীরের  বইগুলি Amazon.com. flipkart.com, abebooks.com এর মাধ্যমে বিক্রি হয়। গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিন থেকে সার্চ করে এখনো পর্যন্ত ১২ লাখের বেশি লোক  প্রবীরের লেখা আর্টিকেল গুলি পড়েছেন। (সূত্র: পুরাণ , বিষ্ণুপুরাণ,wikipedia, পৃথিবীর ইতিহাস) 

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরতি কি ? আরতি কি ভাবে করবেন ? সন্ধ্যা দেওয়ার নিয়ম কি ? পড়ুন এবং দেখুন ।

শ্রী শ্রী মা ষষ্ঠীদেবীর পূজা এবং তাঁর ধ্যান মন্ত্র,প্রণাম মন্ত্র ও ব্রত পালন ।

কলি যুগের অবসান/সমাপ্তি ও কল্কি অবতার - সত্য যুগের পুনঃপ্রতিষ্ঠা- সত্য,ত্রেতা,দ্বাপর,কলি এই চার যুগের সময়,পরিমাণ,বৈশিষ্ট্যসমূহ ও অবতার এবং যুগ পরিবর্তন ।