বেদ এবং পুরাণের সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও ইতিহাস।

 বেদ এবং পুরাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:-

कृष्णं नारायणं वन्दे कृष्णं वन्दे व्रजप्रियम्।
कृष्णं द्वैपायनं वन्दे कृष्णं वन्दे पृथासुतम्॥

বেদ:- সনাতন হিন্দু ধর্মের সর্বপ্রাচীন পবিত্র ধর্মগ্রন্থ । বেদ "অপৌরুষেয়, "নৈর্বক্তিক ও রচয়িতা-শূন্য"। সনাতন ধর্মের  শাস্ত্র অনুযায়ী পরব্রহ্মই সৃষ্টির আদিতে মানব হিতার্থে বেদের জ্ঞান প্রকাশ করেন। তাই সনাতন হিন্দু ধর্মে বেদের স্থান সবার উপরে ,বেদ ই সনাতন হিন্দু ধর্মের মূল ভিত্তি স্তম্ভ।বেদ যেমন পরব্রহ্ম শ্রী হরি নারায়ণের মুখ নিঃসৃত বাণী তেমনি শ্রীমদ্ভগবদ গীতা  শ্রী হরি নারায়ণের অংশ অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ নিঃসৃত বাণী সেই কারনে গীতা বেদের সমতুল্য। সনাতন ধর্মে  বেদ বাক্য  ও গীতার বাণী সর্বোপরি। শ্রীমদ্ভগবত গীতা সংস্কৃত মহাকাব্য মহাভারতের  অংশ তথাপি এটি একটি স্বতন্ত্র ধর্মগ্রন্থের তথা পৃথক শাস্ত্রের মর্যাদা পেয়ে থাকে। বেদ শ্রুতি বিভাগের মধ্যে আসে,শ্রীমদ্ভগবত গীতা স্মৃতি সাহিত্যের মধ্যে আসে। 

শ্রী হরি নারায়ণ ব্রহ্ম রূপে ব্রহ্মা কে বেদ
প্রদান করেন এবং মৎস্য রূপে বেদ কে রক্ষা করেন। 

পুরাণ:-

অত্যন্ত  সহজ  সরল ভাষায় পুরাণ হলো -পুরাকালের  ইতিহাস,ধৰ্ম ,অধর্ম, আখ্যান-উপাখ্যান, ধর্মীয় বিধিবিধান ইত্যাদি সম্বলিত এক শ্রেণীর মিশ্র সাহিত্য এবং  পুরান -সনাতন ধর্মের মহান ধরোহর। 

পুরাণের  উৎপত্তি;-

সাধারণ মানুষের  আগের (প্রাচীন) যুগের ইতিহাস,ধৰ্ম ,অধর্ম, আখ্যান-উপাখ্যান, ধর্মীয় বিধিবিধান ইত্যাদির  গল্পরস আস্বাদনের আকাঙ্ক্ষা থেকে এর উৎপত্তি। সাধারণ মানুষের চাহিদা মেটাতে গল্পের ঢঙে সহজ-সরল ভাষায় রচিত হয় পুরাণগুলি । ভারতীয় জীবন প্রবাহে যে গ্রন্থগুলির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে, সেগুলির মধ্যে পুরাণগুলি প্রাচীন ভক্তিগ্রন্থ হিসাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বিবেচিত হয়। এগুলি  স্মৃতি বিভাগের মধ্যে আসে। স্মৃতি সাহিত্য মানে যা স্মরণ করে লেখা হয়েছে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মুখেমুখে প্রচারিত এবং লিপিকার দের পরিমার্জিত ,পরিবর্তিত ও সংশোধিত হয়েছে। সেই জন্য স্মৃতি সাহিত্যগুলির মধ্যে স্থান ,কাল ও ভাষা  ভেদে পার্থ্যক্য লক্ষ্য করা যায়।


পুরাণের লক্ষণ:-

অমর কোষ  ইত্যাদি প্রাচীন  কোষীয়  গ্রন্থের তথ্য অনুসারে  পুরাণের লক্ষণ সম্পর্কে বলা হয়েছে - যেখানে  ১)  সৃষ্টি ২)  প্রলয় ৩) বংশ ৪). মন্বন্তর এবং ৫) বংশানুচরিত - এই পাঁচটি লক্ষণ থাকবে তাকেই পুরাণ বলা যাবে । 

আমাদের সনাতন ধর্মে মোট ১৮ টি পুরাণের  কথা বলা হয়েছে ,তবে মহাভারতে বায়ু পুরাণ কে ও   পুরাণ  বলা হয়েছে ,এই ১৮ টি পুরাণ  থেকে  যে অন্য পুস্তক গুলি তৈরি হয়েছে ,তাঁদের  উপপুরাণ বলা হয়।

 আমাদের সনাতন ধর্মে মোট ১৮ টি পুরাণের বর্ণনা পাওয়া  যায় ,সেগুলি হলো নিম্ন রূপ:-


 

1.☯বিষ্ণু পুরাণ (২৩,০০০ শ্লোক)  এই পুরাণ টি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও জনপ্রিয় । এই পুরাণে বিষ্ণুর সমস্ত অবতারের কথা বর্ণনা করা হয়েছে  এবং সাথেই ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি, দেব ,দানব ,মানব ,মনু, চন্দ্র ও সূর্য বংশের বিবরণ, বিশ্বের ভূগোল, স্বর্গ-নরক, তীর্থের মহত্ব/মাহাত্ম্য, সূর্য ও বিষ্ণু উপসনার পদ্ধতি, আদিত্যগণের বিবরণ,বেদের সৃষ্টি তত্ত্ব ,সৃষ্টি ও প্রলয় ,বর্ণাশ্রম ধর্ম, নীতিধর্ম ইত্যাদি বর্ণনা করা হয়েছে ।এই পুরাণ টির    রচয়িতা বেদব্যাস ।

ব্রহ্মপুরাণ বা আদিপুরাণ

2.☯
ব্রহ্মপুরাণ বা আদিপুরাণ (রচনাকাল আনুমানিক খ্রিস্টীয় অষ্টম-দ্বাদশ শতাব্দী): শ্লোকসংখ্যা ২৪,০০।এই পুরাণ টির    রচয়িতা বেদব্যাস । কিংবদন্তি অনুসারে, ঋষি রোমহর্ষণ নৈমিষারণ্যে উপস্থিত ঋষিদের কাছে এই পুরাণ প্রথম বর্ণনা করেন। । 


3.☯অগ্নিপুরাণ বা আগ্নেয় পুরাণ: এই পুরাণ টি র   সঠিক রচনাকাল জানা যায় না। শ্লোকসংখ্যা  ১১৫০০। এটি একটি প্রাচীন পুরাণ এবং একে "পৌরাণিক ও সাহিত্যবিদ্যার কোষগ্রন্থ" বলা হয়।এই পুরাণ টির    রচয়িতা বেদব্যাস । কিংবদন্তি অনুসারে, ঋষি বশিষ্ঠের অনুরোধে অগ্নি এই পুরাণ রচনা করেছিলেন। 



4.☯ শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরান (১৮,০০০ শ্লোক) এই পুরাণ টি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও জনপ্রিয় পুরাণ। এই পুরাণের মূল বিষয় বস্তু ভগবান  শ্রীকৃষ্ণের  কাহিনি। শ্রীমদ ভাগবত /ভাগবত পুরাণ  আঠারটি পুরাণের মধ্যে একটি । একে শ্রীমদ্ভাগবতম বা সহজভাবে ভাগবতমও বলা হয় । এই পুরান টি কে মহাপুরান বলা হয়।  ভাগবত পুরাণের সকল কাহিনি ব্যাসের পুত্র শুকদেবের মুখে বর্ণনাচ্ছলে কথিত হয়েছে। এর প্রধান  বিষয়বস্তু হল ভক্তি যোগ। ভাগবত পুরাণকে সমস্ত পুরাণগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। পুরাণগুলির গণনায়, ভাগবতকে অষ্টম পুরাণ হিসাবে নেওয়া হয়েছে (ভাগবত 12.7.23)। এই পুরাণ টি র রচয়িতা বেদব্যাস । ইনি বশিষ্ঠের প্রপৌত্র,পরাশরের পুত্র এবং শুকদেবের পিতা।

বর্তমানে 'ভাগবত' বিবরণ বহনকারী দুটি পুরাণ পাওয়া যায়।

(ক) শ্রীমদ ভাগবত পুরাণ।

(খ ) শ্রীমদ দেবী ভাগবত'/দেবীভাগবত পুরান । 

এই দুটির মধ্যে শ্রীমদ ভাগবত টি  হলো পুরান ,অন্য দিকে শ্রীমদ দেবী ভাগবত'/দেবীভাগবত   টি হলো উপপুরান।


5.☯ভবিষ্য পুরাণ (১৪,৫০০ শ্লোক) এই পুরাণে ভবিষতে কি ঘটনা ঘটিবে তার বর্ণনা  আছে। এই পুরাণ টির    রচয়িতা বেদব্যাস ।এই পুরাণ টি বিভিন্ন  লেখক এর দ্বারা সংকলিত ।


 6.ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ (১২,০০০ শ্লোক । এই পুরাণ টির    রচয়িতা বেদব্যাস ।এই পুরাণের মূল বিষয় বস্তু ব্রহ্মান্ডের কাহিনি। এতে হিন্দু সৃষ্টিতত্ত্ব, কালতত্ত্ব, কল্প ও যুগের বিস্তারিত বিবরণ ও আলোচনা করা হয়েছে । এতে ভরত ও পৃথুর বংশলতিকা [পৃথু  ছিলেন এই  পৃথিবীর প্রথম রাজা,যিনি পৃথিবীকে সমতল করে কৃষি ও বসবাস যোগ্য করেছিলেন, তাঁর নাম থেকেই পৃথিবী নাম টি এসেছে] এবং  দেবতা, ঋষি,অগ্নি এবং বেদাঙ্গ ও আদিকল্পের বিবরণ আছে । এতে ধর্মীয় ভূগোল এবং এতে জম্বুদ্বীপ ও ভারতবর্ষের  বিবরণ পাওয়া যায়।

7.☯ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ (১৮,০০০ শ্লোক) ।এই পুরাণ টির    রচয়িতা বেদব্যাস । এই পুরাণের মূল বিষয় বস্তু ভগবান  শ্রীকৃষ্ণের  কাহিনি। 



8.☯গরুড় পুরাণ (১৯,০০০ শ্লোক) এই পুরাণের  প্রবক্তা ভগবান বিষ্ণু  এবং শ্রোতা গরুড় ,পরে গরুড় ঋষি কাশ্যপ কে এই কথা শোনান। গরুড় পুরাণে, মানুষের  কর্ম, মৃত্যুর পরে তাঁর ফল ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, এর সঙ্গে বলা হয়েছে সুন্দর ও সুখী জীবনযাপনের কথা। এছাড়া  স্বর্গ-নরকের ধারণা,  পিতৃতর্পণাদি ও মোক্ষ-সংক্রান্ত ধ্যানধারণা,নদনদী ও ভূগোল, খনিজ ও বহুমূল্য পাথরের প্রকারভেদ, রত্নের গুণাগুণ বিচারপদ্ধতি, উদ্ভিদ ও ভেষজের তালিকা, বিভিন্ন ধরনের রোগ ও সেগুলির উপসর্গ, বিভিন্ন ধরনের ঔষধ, রোগপ্রতিষেধকসমূহ, হিন্দু পঞ্জিকা ও তার মূল ভিত্তি, জ্যোতির্বিজ্ঞান,  স্থাপত্য, গৃহনির্মাণ, হিন্দু মন্দিরের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ, ষোড়শ সংস্কার, দানধ্যান, অর্থনীতি, ব্যয়সংকোচ, রাজার কর্তব্য, রাজনীতি, রাজকর্মচারী, তাঁদের ভূমিকা ও তাঁদের নিয়োগপদ্ধতি, সাহিত্যের শ্রেণিবিভাগ, ব্যাকরণের নিয়মাবলি ইত্যাদি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। শেষ অধ্যায়গুলিতে বর্ণিত হয়েছে যোগাভ্যাস পদ্ধতি (সাংখ্য ও অদ্বৈত মতানুযায়ী), ব্যক্তিগত উন্নতি ও আত্মজ্ঞানের উপযোগিতার কথা।এই পুরাণ টির    রচয়িতা বেদব্যাস ।


 মৃত্যুর পর সত্‍কার ও পারলৌকিক কাজ কী ভাবে করতে হবে,যাতে বিদেহী আত্মা শান্তি লাভ করে, সেই বিষয়ে লেখা আছে  গরুঢ় পুরাণে। গরুড়পুরাণ হল হিন্দুধর্মের ১৮টি মহাপুরাণের অন্যতম। গরুঢ় পুরাণ অনুসারে মৃত ব্যক্তির আত্মা ১০ থেকে ১৩ দিন মৃত ব্যক্তির বাড়িতে অথবা তাঁর আসে পাশে থাকে। হিন্দুধর্মের নিয়ম ও নীতি অনুসারে বিদেহী আত্মার  শান্তি লাভের জন্য অশৌচ পালন ও পারলৌকিক কাজ গুলি করার সাথে সাথে রোজ (১0-১দিন )মৃত ব্যক্তির বাড়িতে  গরুঢ় পুরাণ পাঠ করতে হয় ,এবং গরুঢ় পুরাণ পাঠ করার আগে মৃত ব্যক্তির প্রসংসা এবং তাঁর আত্মাকে গরুঢ় পুরাণ পাঠ  শোনার জন্য অনুরোধ করতে হয়। গরুঢ় পুরাণ পাঠ  শোনার পরে আত্মা তার পারিবারিক মায়া ,মোহ থেকে মুক্ত হয় এবং তাঁর  আগের কর্তব্য বুঝতে পারে ও মুক্তি ও শান্তি লাভ করে এবং আগের যাত্রা শুরু করে  এবং মৃত ব্যক্তির নামে পিণ্ডদান,সেই যাত্রা পথে তাকে খাদ্য জোগায় ।


 

9.☯কূর্ম পুরাণ (১৭,০০০ শ্লোক) ।এই পুরাণে  ভগবান বিষ্ণুর কচ্ছপ (কূর্ম ) অবতারের বর্ণনা আছে।এই পুরাণ টির    রচয়িতা বেদব্যাস । 

10.☯লিঙ্গ পুরাণ (১১,০০০ শ্লোক) ।এই পুরাণে  ভগবান শিবের উপাসনার বর্ণনা আছে।এই পুরাণ টির    রচয়িতা বেদব্যাস ।

11.☯মার্কণ্ডেয় পুরাণ (৯,০০০ শ্লোক); এই পুরাণের প্ৰবক্তা ঋষি মার্কণ্ডেয় । পবিত্র শাক্ত ধর্মগ্রন্থ দেবীমাহাত্ম্যম্ এই পুরাণভুক্ত ।


12.☯মৎস্য পুরাণ (১৪,০০০ শ্লোক)এই পুরাণে  ভগবান বিষ্ণুর মৎস্য অবতারের বর্ণনা আছে। এই পুরাণ টির    রচয়িতা বেদব্যাস । এই পুরাণ টি -বিভিন্ন  লেখক এর দ্বারা সংকলিত 

13.☯নারদ পুরাণ (২৫,০০০ শ্লোক) । এই পুরাণ টির    রচয়িতা বেদব্যাস ।এই পুরাণে ধৰ্ম ,জ্যোতিষ ,শ্রাদ্ধ ,প্রায়শ্চিত্ত ,গৃহ বিচার  ইত্যাদির বর্ণন  আছে। 

14.☯পদ্ম পুরাণ (৫৫,০০০ শ্লোক) ।এই পুরাণ টির    রচয়িতা বেদব্যাস ।কিংবদন্তি অনুসারে, ঋষি লোমহর্ষণ  এর পুত্র শ্রুত উগ্রশ্রবা নৈমিষারণ্যে উপস্থিত ঋষিদের কাছে এই পুরাণ প্রথম বর্ণনা করেন।


15.☯শিব পুরাণ (২৪,০০০ শ্লোক) এই পুরাণে  ভগবান শিবের উপাসনার বর্ণনা আছে। এই পুরাণ টির    রচয়িতা বেদব্যাস ।

16.☯স্কন্দ পুরাণ (৮১,১০০ শ্লোক) –  এই পুরাণের মূল বিষয় বস্তু ভগবান কার্তিকের  কাহিনি। একাধিক পাঠান্তর সংবলিত এই পুরাণে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বহু কাহিনি-উপকাহিনি ও কিংবদন্তির কথা। একাধিক গ্রন্থে এই পুরাণের উদ্ধৃতি প্রাপ্ত হয়। এটি একটি বৃহত্তম পুরাণ।এই পুরাণ টির    রচয়িতা বেদব্যাস ।


বামন পুরাণ

17.☯বামন পুরাণ (১০,০০০ শ্লোক) এই পুরানের  রচয়িতা বেদব্যাস।এই পুরাণে  ভগবান বিষ্ণুর বামন  অবতারের বর্ণনা আছে।

18.☯বরাহ পুরাণ (১০,০০০ শ্লোক) এই পুরাণ টি রচয়িতা বেদব্যাস।এই পুরাণে  ভগবান বিষ্ণুর বরাহ অবতারের বর্ণনা আছে।

মহাভারতে বায়ু পুরাণ কে (২৪,০০০ শ্লোক) ১৯ তম পুরাণ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এই পুরাণে  ভগবান শিবের উপাসনার বর্ণনা আছে।একে  শিব পুরাণ ও  বলা হয়।

বেদ:-

বেদ (সংস্কৃত: वेद) হল "অপৌরুষেয়" ("পার্থিব পুরুষ" দ্বারা কৃত নয়) অলৌকিক দিব্যজ্ঞান এবং পরম পুরুষ নারায়ণের আত্মবচন/ অমোঘ বাণী "এর  কোনও রচয়িতা নেই, । বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় রচিত  এই তত্ত্বজ্ঞানই (বেদই) সংস্কৃত সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন এবং সনাতন ধর্মের সর্বপ্রাচীন পবিত্র ধর্মগ্রন্থ।

 বেদকে শ্রুতি (যা শ্রুত হয়েছে) সাহিত্যও বলা হয়,কারণ এই দিব্যজ্ঞান কে শুনে শুনে মনে  রাখা  হত  । এইখানেই সনাতন ধর্মের অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলির সঙ্গে বেদের পার্থক্য। কারণ, সনাতন ধর্মের অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলিকে বলা হয় স্মৃতি (যা স্মরণ করে লেখা হয়েছে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মুখেমুখে প্রচারিত এবং সংশোধিত) সাহিত্য।  বেদে মোট মন্ত্র সংখ্যা 20379 টি।


বেদের সংখ্যা চার: ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ। প্রত্যেকটি বেদ আবার চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত: সংহিতা (মন্ত্র ও আশীর্বচন), আরণ্যক (দর্শন ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও প্রতীকী যজ্ঞ), ব্রাহ্মণ (ধর্মীয় আচার, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও যজ্ঞাদির উপর টীকা) ও উপনিষদ্‌ (এতে পরমেশ্বর,পরমাত্মা ও জীবাত্মার স্বভাব ও সম্মন্ধ কে দাৰ্শনিক এবং জ্ঞান  পূর্বক বর্ণনা  করা হয়েছে।

বেদের আভিধানিক অর্থ 'জ্ঞান'।
বেদ  সনাতন  ধর্মের বৈদিক ধারণা ও অনুশীলনকে সংহিতাবদ্ধ করে  হিন্দুধর্মের ভিত্তি স্থাপন করেছে।

বেদের চারটি অংশ: ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ববেদ।  এই গ্রন্থগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপ:



1. ঋগ্বেদ - এটি প্রাচীন এবং প্রথম বেদ, যাতে মন্ত্রের সংখ্যা 10552, মণ্ডলের সংখ্যা 10 এবং সূক্তের সংখ্যা 1028। এই বেদের সূক্তগুলিতে বিশ্বতত্ত্ব ও দেবতাদের স্তবস্তোত্রাদি আলোচিত হয়েছে ।

2. যজুর্বেদ - এতে কার্য (ক্রিয়া-কর্ম) এবং যজ্ঞ (উৎসর্গ) প্রক্রিয়ার জন্য 1975 টি মন্ত্র রয়েছে।

3. সামবেদ - এই বেদের প্রধান বিষয় হল সংগীত ও উপাসনা। এই বেদে 1875 সংগীত / উপাসনা মন্ত্র রয়েছে।

4. অথর্ববেদ - এতে পুণ্য, ধর্ম, স্বাস্থ্য এবং যজ্ঞের জন্য 5977 টি মন্ত্র রয়েছে।

চতুর্বেদ কে বুঝার ,জানার ও অধ্যয়নের জন্যে  ছয়টি শাস্ত্র (উপাঙ্গ)- দশটি উপনিষদ,ছয়টি অঙ্গের (বেদাঙ্গ)-অবলোকন ও  অধ্যয়ন প্রয়োজন।







চতুর্বেদ কে বুঝার ,জানার ও অধ্যয়নের জন্যে যে ছয়টি শাস্ত্রের  প্রয়োজন সেগুলি হলো নিম্নরূপ। 

1.পূর্বমীমাংসা /মীমাংসা শাস্ত্র (পাঠ্য বেদের ব্যাখ্যার জন্য নিয়ম প্রদান করে ও বৈদিক আচার পালনের জন্য দার্শনিক ন্যায্যতা প্রদান করে)।

2.বৈশেষিক শাস্ত্র।

3.ন্যায় শাস্ত্র।

 4.যোগ শাস্ত্র।

5.সাংখ্য শাস্ত্র (সম্যক জ্ঞান-জগৎ দু'টি সত্যের দ্বারা গঠিত; পুরুষ ও প্রকৃতি) ।

6.বেদান্ত শাস্ত্র (বেদের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত)।

 চতুর্বেদ কে বুঝার ,জানার ও অধ্যয়নের জন্যে যে দশটি উপনিষদের প্রয়োজন সেগুলি হলো নিম্নরূপ।

1. ইশা / ঈশাবাস্য (শুক্ল যজুর্বেদ)।

2. কেন / কেনোপনিষদ (সামবেদ)।

3. কঠ/কঠপনিষদ (কৃষ্ণ যজুর্বেদ)।

4. প্রশ্ন উপনিষদ (অথর্ববেদ)।

5. মুণ্ডক/মুণ্ডকোপনিষদ (অথর্ববেদ)।

6. মান্ডুক্য / মান্ডুক্যোপনিষদ (অথর্ববেদ)।

7. ঐতরেয় / ঐতরেয়োপনিষদ (ঋগ্বেদ)।

8. তৈত্তিরেয় / তৈত্তিরীয় উপনিষদ (কৃষ্ণ যজুর্বেদ)।

9. ছান্দোগ্য উপনিষদ (সামবেদ)।

10. বৃহদারণ্যক উপনিষদ (শুক্ল যজুর্বেদ)। 

সনাতন ধর্মে উপনিষদের সংখ্যা প্রায় 108টি, কিন্তু প্রধান উপনিষদ 13 টি  ।প্রতিটি উপনিষদ কোন না কোন বেদের সাথে যুক্ত। এর মধ্যে ঈশ্বর, পরমাত্মা-ব্রহ্ম ও আত্মার স্বরূপ ও সম্পর্কের অত্যন্ত দার্শনিক ও জ্ঞানপূর্ণ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। জগদ্গুরু আদি শঙ্করাচার্য 10টি উপনিষদে তাঁর ভাষ্য দিয়েছেন- এগুলি হল (1) ঈশা (2) ঐতরেয় (3) কঠ  (4) কেন (5) ছান্দোগ্য (6) প্রশ্ন (7) তৈত্তিরীয় (8) বৃহদারণ্যক (9) মান্ডুক্য (10)  মুন্ডক। এই দশ টি উপনিষদ বেদ  পাঠ  করার আগে পাঠ  করা  প্রয়োজন,কারণ তাহলেই  বেদ অধ্যয়ন করে তার মূল ভাব জানা সম্ভব ।জগদ্গুরু আদি শঙ্করাচার্য  নিম্নলিখিত তিনটি উপনিষদকে প্রমাণ বিভাগে রেখেছেন- (1) শ্বেতাশ্বতর (কৃষ্ণ যজুর্বেদ) (2)কৌশিতকী  (ঋগ্বেদ) (3) মৈত্রায়ণী (সামবেদ)।

বেদাঙ্গ - বেদার্থ জ্ঞানে সাহায্যকারী শাস্ত্রকে বেদাঙ্গ বলে। শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, ছন্দ ও নিরুক্ত- এই ছয়টি বেদাঙ্গ (ছয়টি অঙ্গ)। এই ছয়টি বেদাঙ্গ জ্ঞানে পণ্ডিত, বিশারদ,পারদর্শী ব্রাহ্মণদের উৎকল প্রদেশের রাজাদের দ্বারা ষড়ঙ্গী  উপাধি দেওয়া হয়েছিল।

চতুর্বেদ কে বুঝার ,জানার ও অধ্যয়নের জন্যে যে ছয়টি অঙ্গের (বেদাঙ্গ) প্রয়োজন সেগুলি হলো নিম্নরূপ।

1. শিক্ষা - এতে বেদ মন্ত্র উচ্চারণের পদ্ধতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে,এর মূল উদ্দেশ্য হল বেদ মন্ত্রগুলিকে বিনা বাধায় শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করা। 

2. কল্প - বেদের কোন মন্ত্র কোন কাজে ব্যবহার করতে হবে, এতে তা বলা হয়েছে। এর তিনটি শাখা রয়েছে- শ্রৌতসূত্র, গৃহসূত্র ও ধর্মসূত্র।  এতে যজ্ঞ সংক্রান্ত বিধানও  দেওয়া হয়েছে।

3. ব্যাকরণ -ব্যাকরণ  ভাষার মূলতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্বের আলোচনা ও স্পষ্টরূপে বর্ণনা,করে। প্রকৃতি এবং প্রত্যয় ইত্যাদির সংমিশ্রণে, শব্দের সিদ্ধি এবং স্বরযুক্ত স্বরগুলির অবস্থা বোঝা যায় ব্যাকরণের সাহায্যে। বেদ ও শাস্ত্রের উদ্দেশ্য জানতে এবং শব্দের সঠিক জ্ঞানের জন্য  ব্যাকরণের অধ্যয়ন আবশ্যক। এই ক্ষেত্রে পাণিনীয় ব্যাকরণ বেদাঙ্গের প্রতিনিধিত্ব করে। ব্যাকরণকে বেদের মুখও বলা হয়।

4. নিরুক্ত - যা নিরবচ্ছিন্নভাবে বলা হয় তা হলো নিরুক্ত। বেদের অর্থ নিরবচ্ছিন্নভাবে/ সম্পূর্ণভাবে নিরূপনের জন্য বৈদিক শাস্ত্র হল  নিরুক্ত। বেদে যেসব শব্দের অর্থ ব্যবহৃত হয়েছে, সেসব অর্থ অবশ্যই নিরুক্তে উল্লেখ করা হয়েছে। একে বলা হয়েছে বেদ পুরুষের কান। একে বেদের আত্মাও বলা হয়েছে।

5. জ্যোতিষশাস্ত্র - এখান থেকে বৈদিক যজ্ঞ ও আচার-অনুষ্ঠানের সময়কাল জানা যায়। এখানে জ্যোতিষ মানে 'বেদাং জ্যোতিষ'। জ্যোতিষশাস্ত্রকে বেদ পুরুষের চক্ষু বলে মনে করা হয়। বেদ যজ্ঞকর্মে জড়িত এবং যজ্ঞ কালের উপর নির্ভরশীল এবং কালের জ্ঞান জ্যোতিষশাস্ত্র থেকে আসে। অনেক বৈদিক ধাঁধার জ্ঞানও জ্যোতিষশাস্ত্র ছাড়া সম্ভব নয়।

6. ছন্দ -বেদে ব্যবহৃত গায়ত্রী, উষ্ণিক প্রভৃতি শ্লোকের রচনার জ্ঞান ছন্দশাস্ত্র থেকে জানা যায়। একে বেদ পুরুষের পদ (পা) বলা হয়েছে।  এর উদ্দেশ্য হল বৈদিক মন্ত্রগুলির যথাযথ পাঠ রক্ষা করা। 🙏

এই হল  বেদ এবং  পুরাণের সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও  ইতিহাস।🙏

লেখকের মন্তব্য:-এই নিবন্ধটি ভগবান জগন্নাথের ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণায় লেখা হয়েছে। যদি কেউ বা কোনও সংস্থা এই নিবন্ধের কোনও বিষয়বস্তুর সাথে একমত না হন  তবে তিনি বা তারা এটিকে দলিল প্রমাণ সহ মন্তব্যে উল্লেখ করতে পারেন এবং এটি সংশোধন করা হবে। ডকুমেন্টারি প্রমাণ এবং তথ্যের উৎস  ছাড়া এই বিষয়ে যে কোনও মন্তব্যকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং  অসাধু বলে গণ্য করা হবে এবং মুছে ফেলা হবে। 

সবাই ভালো থাকুন ,সুস্থ থাকুন। সমগ্র মানব জাতি ও জীব জন্তুর  কল্যাণ হোক। শান্তির জয় হোক,সত্যের জয় হোক,মানবতার জয় হোক ,সনাতন ধর্মের জয়  হোক। 🙏হে প্রভু আমাকে শুধু জ্ঞান দাও, ভক্তি দাও আর শক্তি দাও🙏



















আমি এই আর্টিকেল টি আমার এক মাত্র 
ছেলে ৺  >আকাশের< জন্য উৎসর্গ করিলাম।
Appreciation Mail of  Jeremie Lumbroso
 lecturer Princeton University. USA



 লেখক পরিচিতি:-প্রবীর মহান্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের  উৎকল ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।  প্রবীরের  বইগুলি Amazon.com. flipkart.com, abebooks.com এর মাধ্যমে বিক্রি হয়। গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিন থেকে সার্চ করে এখনো পর্যন্ত ১২ লাখের বেশি লোক  প্রবীরের লেখা আর্টিকেল গুলি পড়েছেন।


এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সত্য,ত্রেতা,দ্বাপর,কলি এই চার যুগের সময়,পরিমাণ,বৈশিষ্ট্যসমূহ ও অবতার এবং যুগ পরিবর্তন ও কল্কি অবতার।

ষড়রিপু এবং মানব জীবনে ষড়রিপুর প্রভাব:ষড়রিপু কে নিয়ন্ত্রণ বা দমন করার উপায়।

আরতি কি ? আরতি কি ভাবে করবেন ? সন্ধ্যা দেওয়ার নিয়ম কি ? পড়ুন এবং দেখুন ।