ভগবান শিব - শিবরাত্রি এবং মহাশিবরাত্রি।

শিব আক্ষরিক অর্থে "শুভ" বা "মঙ্গল"। তিনি ত্রিমূর্তির  অন্যতম।  শিব ধ্বংসের প্রতীক।তাঁর অন্য নাম গুলি হল -মহেশ /মহেশ্বর, শঙ্কর, ভোলানাথ, নীলকণ্ঠ, মহাদেব, রুদ্র ইত্যাদি। তাঁর তৃতীয় নয়ন, গলায় বাসুকী নাগ, জটায় অর্ধচন্দ্র, জটার উপর থেকে প্রবাহিত গঙ্গা, তাঁর অস্ত্র- ত্রিশূল ও বাদ্য ডমরু। তাঁর মন্ত্র :-ওঁ নমঃ শিবায়।





 



ব্যুৎপত্তি ও  নাম :
প্রথমে এই মহাবিশ্বে কিছুই ছিল না সম্পূর্ন শূন্য ছিল । সেই শূন্যতার সৃষ্টি মহা জ্যোতি পূঞ্জ থেকে । সেই জ্যোতি ধীরে ধীরে মানুষ রূপ ধারন করে ।সেই আদি পূরুষ হচ্ছেন ভগবান নারায়ন । তারপর নারায়ন যোগ নিদ্রায় মগ্ন হন  ।সেই যোগ নিদ্রা থেকে ব্রহ্মা জল নির্গত হয় ও ক্ষীর সাগরের তৈরী হয় । এরপর শ্রী নারায়নের নাভী থেকে একটি পদ্মফুলের কলি সৃষ্টি হয় এবং নারায়নের একটি প্রতিরুপ গিয়ে ঐ পদ্মফুলকে প্রস্ফুটিত করেন ।ঐ পদ্মথেকে ব্রহ্মার সৃষ্টি হয় । এরপর নারায়নের ভ্রকুটি থেকে একটি রুদ্রাক্ষের সৃষ্টি হয় । পরে নারায়নের একটি প্রতিরূপ গিয়ে তার বিষ্ফোরন ঘটিয়ে শিবের সৃষ্টি করেন  । এরপর ব্রহ্মা ও শিব নারায়নের স্তুতি করেন ও তাদের পরিচয় জানতে চান , তারা বলেন হে নারায়ণ জন্মযখন দিয়েছেন পরিচয়ও দিন । তখন শ্রী নারায়ন মধুর হাসি হেসে বলেন আমিও যা আপনারাও তা । আমার প্রতিরূপ আপনারা । হে পঞ্চমুখী আপনি ব্রহ্মা আর হে জটাধারী হে ত্রিনেত্রেশ্বর আপনি শিব । আমরা তিনজন ত্রিদেব ।
শিবের  গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য এবং তাঁর  বিভিন্ন রূপ এবং নাম  :-
 অর্ধচন্দ্র: শিবের মস্তকে একটি অর্ধচন্দ্র বিরাজ করে। এই কারণে শিবের অপর নাম চন্দ্রশেখর । তাঁর  কপালের মধ্যিখানে জ্বলজ্বল করেন তৃতীয় নয়ন। এই কারণে শিবের অপর নাম ত্রিলোচন । জটাজুট: শিবের মস্তকের কেশরাশি জটাবদ্ধ। এই কারণে শিবের অপর নাম জটাধারী।নীলকণ্ঠ: সমুদ্রমন্থনকালে উত্থিত হলাহল বিষ পান করে শিব নীলকণ্ঠ  নামে পরিচিত।  গঙ্গার মর্ত্যে অবতরণকালে শিব তাঁকে জটায় ধারণ করছেন;এই কারণে শিবের অপর নাম গঙ্গাধর।ব্যাঘ্রচর্ম: শিবের পরিধেয় বস্ত্র ব্যাঘ্রচর্ম বা বাঘছাল। এই কারণে শিবের অপর নাম কৃত্তিবাস।সর্প: শিবের গলায় একটি সাপ(বাসুকি নাগ)  সর্বদা শোভা পায়।ত্রিশূল: শিবের অস্ত্র হল ত্রিশূল। ডমরু: শিবের হাতে ডমরু নামে একপ্রকার বাদ্যযন্ত্র শোভা পায়।নন্দী: নন্দী নামে একটি পৌরাণিক ষাঁড় শিবের বাহন। শিবকে পশুদের দেবতা মনে করা হয়। তাই তাঁর অপর নাম পশুপতি । গণ: শিবের অনুচরদের গণ বলা হয়। এঁদের নিবাসও কৈলাস। এঁদের ভৌতিক প্রকৃতি অনুসারে ভূতগণ নামেও অভিহিত করা হয়। এঁরা সাধারণত দয়ালু। কেবল কোনো কারণে তাঁদের প্রভু ক্রুদ্ধ হলে, এঁরা প্রভুর সঙ্গে ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠেন। শিব স্বীয় পুত্র গণেশকে তাঁদের নেতা মনোনীত করেন। এই কারণেই গণেশ গণপতি নামে অভিহিত হন।
কৈলাস: শিবের অধিষ্ঠান হিমালয়ের কৈলাস পর্বতে।
বারাণসী: বারাণসী শিবের প্রিয় নগরী। এই নগরী হিন্দুদের পবিত্রতম তীর্থগুলির অন্যতম। হিন্দু ধর্মগ্রন্থে এই নগরী কাশীধাম নামে পরিচিত।
 শিবের  রূপ 
শিব একদিকে তিনি যেমন  ভয়ংকর (রুদ্র); অন্যদিকে তেমনই দয়ালু ও মঙ্গলময় (শিব)।  শিবের  দুই ভয়ংকর রূপ হল "কাল"  ও "মহাকাল" । এই দুই রূপে শিব সকল সৃষ্টি ধ্বংস করেন। ধ্বংসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত শিবের অপর একটি রূপ হল ভৈরব । "ভৈরব" শব্দটির অর্থও হল "ভয়ানক"।অপরপক্ষে শিবের শংকর  নামটির অর্থ "মঙ্গলকারক" বা "আনন্দদায়ক"। এই নামটি শিবের দয়ালু রূপের পরিচায়ক।
 যোগী ও গৃহীদেবতা সপরিবার শিব; শিবের সঙ্গে পত্নী পার্বতী এবং পুত্র গণেশ ও কার্তিকেয়।শিবকে একাধারে যোগী ও গৃহী রূপে কল্পনা করা হয়। যোগশাস্ত্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে মহাযোগী নামে অভিহিত করা হয়। গৃহী রূপে তিনি পার্বতীর স্বামী এবং গণেশ ও কার্তিকেয় নামে দুই পুত্রের জনক। পার্বতী বা উমা তাঁর স্ত্রী বলে তাঁকে উমাপতি, উমাকান্ত ও উমাধব নামে ও অভিহিত করা হয়। শিবের স্ত্রী পার্বতীই বিশ্বজননী বা মহাশক্তি। শিব ও পার্বতীর দুই পুত্র – কার্তিকেয় ও গণেশ। দক্ষিণ ভারতে সুব্রহ্মণ্যন, ষন্মুখন, স্বামীনাথন ও মুরুগান নামে কার্তিকেয়ের পূজা বহুল প্রচলিত; উত্তর ভারতে তিনি স্কন্দ, কুমার ও কার্তিকেয় নামেই সর্বাধিক পরিচিত। মৃত্যুঞ্জয়-"মৃত্যুঞ্জয়" কথাটির আক্ষরিক অর্থ "যিনি মৃত্যুকে জয় করেছেন"। কথিত আছে, শিব মৃত্যুর দেবতা যমকে জয় করেছিলেন। একটি কিংবদন্তি অনুসারে, ঋষি মার্কণ্ডেয়ের ষোলো বছর বয়সে মৃত্যুযোগ ছিল। মার্কণ্ডেয় শিবের আরাধনা করেন। মৃত্যুকাল উপস্থিত হলে, তিনি শিবের নিকট জীবন ভিক্ষা করেন। শিব যমকে পরাজিত করে মার্কণ্ডেয়কে জীবন দান করেন। 

অর্ধনারীশ্বর:-
 অর্ধনারীশ্বর বেশে শিব অর্ধেক পুরুষ অর্ধেক নারীদেহধারী।ত্রিপুরান্তক 
একটি পৌরাণিক উপাখ্যান অনুসারে, শিব ধনুর্ধর বেশে ত্রিপুর নামে অসুরদের তিনটি দুর্গ ধ্বংস করেন। এই কারণে শিবের অপর নাম ত্রিপুরান্তক মানবদেহ তিন প্রকার - স্থূল শরীর বা বহিঃস্থ দেহ, সূক্ষ্ম শরীর বা মন এবং কারণ শরীর বা আত্মার চৈতন্যময় রূপ। এই তিন শরীরকে একত্রে ত্রিপুর বলা হয়।।  ত্রিপুরান্তক বেশে শিব মানব সত্ত্বার এই ত্রিমুখী অস্তিত্বের ধ্বংস ও বিলোপ ঘটিয়ে মানবকে পরমসত্ত্বার সঙ্গে লীন হতে সহায়তা করেন। এই বেশে তিনি মায়া ও অজ্ঞানকে ধ্বংস করে পরম চৈতন্যের সঙ্গে মানুষের মিলন ঘটান।

অষ্টমূর্তি
অষ্টমূর্তিশিবের আটটি বিশেষ রূপকে একত্রে অষ্টমূর্তি বলে। এঁরা হলেন: ভব (অস্তিত্ব), শর্ভ (ধনুর্ধর), রুদ্র (যিনি দুঃখ ও যন্ত্রণা প্রদান করেন), পশুপতি (পশুপালক), উগ্র (ভয়ংকর), মহান বা মহাদেব (সর্বোচ্চ আত্মা), ভীম (মহাশক্তিধর) ও ঈশান (মহাবিশ্বের দিকপতি)।
শিবলিঙ্গ :-
 শিব শব্দের অর্থ মঙ্গলময় এবং লিঙ্গ শব্দের অর্থ প্রতীক; এই কারণে শিবলিঙ্গ শব্দটির অর্থ সর্বমঙ্গলময়


 পঞ্চমন্ত্র 
শিবের পবিত্র সংখ্যা হল পাঁচ। তাঁর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রগুলির একটি (ওঁ -নমঃ শিবায়) পাঁচটি অক্ষর দ্বারা গঠিত।কথিত আছে, শিবের শরীর পাঁচটি মন্ত্র দ্বারা গঠিত।
 হরিহর
(বামার্ধে – নীল বর্ণে) ও শিব (দক্ষিণার্ধে – শ্বেতবর্ণে)
 শিবরাত্রি
 শিবরাত্রি নিয়ে শোনা যায় এক প্রচলিত কাহিনি। কাশীতে এক ব্যাধ বাস করত। সারা দিন বনে শিকার করে সন্ধ্যায় সে বাড়ি ফিরত। এমনই এক বনে গিয়ে সারাদিন অনাহারে ক্লান্ত সেই ব্যাধ একটি গাছের নীচে বিশ্রাম নিচ্ছিল। যখন তার ঘুম ভাঙল তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। ব্যাধ বুঝতে পারল সে দিন আর গভীর জঙ্গল অতিক্রম করে বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়। তাই ঠিক করল একটি গাছের উপরে রাত কাটিয়ে পর দিন বাড়ি ফিরবে। কাছেই ছিল একটি প্রাচীন বেলগাছ। ব্যাধ তখন কাছেই একটি বেলগাছের ডালে শিকারগুলিকে বেঁধে রেখে নীচে একটি শক্ত ডালের উপরে বসে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

সেই বেলগাছের কাছেই একটি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত ছিল। গাছের উপরে ব্যাধের নড়াচাড়ার ফলে একটি বেলপাতা সেই শিবলিঙ্গের উপরে গিয়ে পড়ে। সে দিন ছিল শিবচতুর্দশী বা শিবরাত্রি। নিজের অজান্তেই উপবাসী থেকে বেলগাছের একটি পাতা শিবলিঙ্গের উপরে পড়ায় সেই ব্যাধের ব্রত পালন হয়ে গিয়েছিল। পর দিন বাড়ি ফিরে, স্নান সেরে সে খেতে বসবে, এমন সময় তাঁর বাড়িতে অতিথি এসেছিল। ব্যাধ অতিথি সেবার রীতি মেনে খাওয়ানোরও ব্যবস্থা করল। ফলে নিজের অজান্তে সে ব্রতের সম্পূর্ণ ফল লাভ করেছিল। বহু বছর পরে ব্যাধের মৃত্যুর সময় এক দিকে যমদূতেরা, অন্য দিকে শিব দূতেরা তাকে নিতে উপস্থিত হল। এই নিয়ে যুদ্ধও বেঁধে গেল। অবশেষে যখন যমদূতরা কৈলাসে শিবের কাছে নালিশ করতে গিয়েছিল ঠিক তখনই শিবের প্রহরী নন্দী যমদূতদের বলেন, যেহেতু ব্যাধ শিবচতুর্দশীর ব্রত পালন করে পুণ্য অর্জন করেছে তাই তাকে যমদূতেরা নিয়ে যেতে পারেন না। যমদূতরা, যমরাজের কাছে গিয়ে যখন এ কথা জানাল যমরাজ নাকি বলেছিলেন, এই ব্রত যে পালন করবে তার উপর যমের কোনও অধিকার থাকবে না। এই ব্রত মানুষকে সর্ব পাপ থেকে উদ্ধার করে। সেই বিশ্বাস নিয়ে পুণ্যার্জনের আশায় নারী-পুরুষ যুগ যুগ ধরে এই ব্রতের পালন করে আসছেন। ভগবান শিবের ব্রত  গুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্রত হলো মহাশিবরাত্রি ব্রত। 
মহাশিবরাত্রি -

শিবমহাপুরাণ অনুসারে এইরাত্রেই এইরাত্রেই ভগবান শিব ও মাতা  পার্বতীর বিবাহ হয়েছিল । এই মহাশিবরাত্রিতে শিব তার প্রতীক লিঙ্গ তথা শিবলিঙ্গ রূপে প্রকাশিত হয়ে জীবের পাপনাশ ও মুক্তির পথ দিয়েছিলেন।আবার  এই মহাশিবরাত্রিতে  শিব সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের মহা তান্ডব নৃত্য করেছিলেন । সবাই ভালো থাকুন ,সুস্থ থাকুন। সমগ্র মানব জাতি ও জীব জন্তুর  কল্যাণ হোক। শান্তির জয় হোক,সত্যের জয় হোক,মানবতার জয় হোক ,সনাতন ধর্মের জয়  হোক। 🙏হে বাবা ভোলেনাথ আমাকে শুধু জ্ঞান দাও ,ভক্তি দাও আর শক্তি দাও🙏
 
                                                                            





 প্রবীর  ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের  উৎকল ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।  প্রবীরের  বইগুলি Amazon.com. flipkart.com, abebooks.com এর মাধ্যমে বিক্রি হয়। গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিন থেকে সার্চ করে এখনো পর্যন্ত ১২ লাখের বেশি লোক  প্রবীরের লেখা আর্টিকেল গুলি পড়েছেন।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সত্য,ত্রেতা,দ্বাপর,কলি এই চার যুগের সময়,পরিমাণ,বৈশিষ্ট্যসমূহ ও অবতার এবং যুগ পরিবর্তন ও কল্কি অবতার।

ষড়রিপু এবং মানব জীবনে ষড়রিপুর প্রভাব:ষড়রিপু কে নিয়ন্ত্রণ বা দমন করার উপায়।

আরতি কি ? আরতি কি ভাবে করবেন ? সন্ধ্যা দেওয়ার নিয়ম কি ? পড়ুন এবং দেখুন ।